রিয়াদুল হাসান
আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) পৃথিবীতে কী পরিবর্তন ঘটাতে এসেছিলেন?
তিনি কি এমন একটি জাতি সৃষ্টি করতে এসেছিলেন যাদের সবাই আরবের পোশাক পরিধান করবে, দাড়ি রাখবে? যার সদস্যরা সবাই হবে আরবি ভাষার প-িত?
নাকি তিনি এসেছিলেন সমাজ থেকে সকল জাহেলিয়াত, সকল অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, জুলুম, রক্তপাত, অশ্রু দূর করে একটি শান্তি, ন্যায়, সুবিচারপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের জন্য?
বস্তুত তিনি এমন একটি জাতি তৈরি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন যে জাতির সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবন ও সম্পদ দিয়ে লড়াই করে সমগ্র পৃথিবীকে আল্লাহর নাজিল করা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসবে। পবিত্র কোর’আনের অন্তত তিনটি আয়াতে আল্লাহ এই উদ্দেশ্যকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন,
“তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রসুলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) ও সত্যদীন সহকারে যেন তিনি সকল প্রচলিত জীবনব্যবস্থার উপরে একে বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।” (সুরা তওবা ৩৩, সুরা সফ ৯, সুরা ফাতাহ ২৮)। এটাই যে তাঁর রসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য সে বিষয়ে যেন কোনা ভিন্নমত, বিতর্ক বা সন্দেহের লেশও না থাকে সে জন্য তিনি এ কথাটিও যুক্ত করে দিয়েছেন যে, এর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ স্বয়ং যথেষ্ট, কাফি।
পৃথিবীতে এমনিতেই বহু সংখ্যক উপাসক সম্প্রদায় ছিল এবং আছে। রসুলাল্লাহ (সা.) এর মধ্যে আরো একটি উপাসক সম্প্রদায় যোগ করার জন্য আসেন নি। তিনি অর্থহীন কাজ করার মানুষ ছিলেন না। তিনি যে উম্মাহ গড়ে তুলেছিলেন সে উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের মনে মগজে তিনি গেড়ে দিয়েছিলেন যে কেন তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পৃথিবীতে তাদের কাজ কী? তিনি নিজে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র দশ বছরে অন্তত একশত সাতটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। নিজে অংশ নিয়েছেন সাতাশটিতে। এভাবে তিনি হেজাজের সাড়ে বারো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূখ-ে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি অকল্পনীয় ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ, জ্ঞানে বিজ্ঞানে, সম্পদে সমৃদ্ধ একটি সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণ করে যান। তিনি ও তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদার যুগে এই সভ্যতার রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামরিক শৃঙ্খলা, সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এই উম্মাহ সামরিক শক্তিবলে তদানীন্তন অর্ধ দুনিয়ার কর্তৃত্ব অর্জন করে এবং সেখান থেকে সকল অন্যায় অবিচার অনাচার দূর করে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করে। সেটা ছিল মুসলিম উম্মাহর সোনালি অধ্যায়।
আর আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকে মুসলিম মানে হচ্ছে নিছক একটি উপাসক সম্প্রদায়। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ যাবতীয় অঙ্গনে কর্তৃত্ব করছে পাশ্চাত্যের তৈরি বিধি-নিষেধ ও মূল্যবোধ। সংখ্যার আধিক্য ছাড়া তাদের আর গৌরব করার কিছুই নেই। কিন্তু মর্যাদা লাভের জন্য কোয়ান্টিটি বা সংখ্যার কোনো গুরুত্ব বাস্তবে থাকে না। গুরুত্ব থাকে কোয়ালিটি বা গুণাবলীর। সেই জাতি ছিল ঝড়ের মতো গতিশীল। অর্ধেক দুনিয়ার শাসন কার্য পরিচালনার জন্য তাদেরকে দিনরাত থাকতে হয়েছে কর্মব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে সামনে আসছে নতুন নতুন সংকট। সেগুলোর মোকাবেলা করে জাতি প্রতি মুহূর্তে পার হয়ে যাচ্ছে উৎকর্ষের একেকটি সোপান। এভাবে জাতি উঠে গেছে উন্নতির চরম শিখরে। মানবজাতি প্রত্যক্ষ করল ঐশী কেতাবের জ্যোতি কতটা প্রখর হতে পারে। মানবজাতি ন্যায় ও সত্যের বাস্তব রূপ দেখল মোমেনদের মাধ্যমে।
অন্যান্য জাতি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে মুসলিম শাসকদের হিমাদ্রিসম ব্যক্তিত্ব, তাদের সভ্যতার বিরাটত্ব ও চিন্তার উদারতা। তারা তাকিয়ে থেকেছে মুসলিম শাসনের রাজনৈতিক কেন্দ্র বাগদাদ, আলেকজান্ড্রিয়া, ইস্তাম্বুল, গ্রানাডা, কর্ডোবা, আলেপ্পো, কায়রোয়ান, তিলমেসান, নাজাফ, দামেস্ক, বোখারা, সমরখন্দ, দিল্লি, গৌড়ের নগরসমূহের পানে। ঠিক যেভাবে আজ আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকি নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মস্কো, আমস্টার্ডাম, প্যারিস, ভিয়েনা, অসলো ইত্যাদি পাশ্চাত্যের উন্নত শহরের দিকে।
আজ আমরা ভুলে গেছি কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষগণ অর্ধেক পৃথিবীতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কী ছিল তাদের সিস্টেম বা ব্যবস্থাগুলো। আসুন বিস্মৃতির কালো পর্দা সরিয়ে সেই সোনালি অতীতের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করি। ইসলামের এই গৌরবময় যুগের কথা সকল মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন। এমন কি বহু অমুসলিম ঐতিহাসিক যাদের মধ্যে অনেকেই ইসলামের বিদ্বেষী তারাও মুসলমানদের আলোক উদ্ভাসিত সময়ের উচ্চকিত প্রশংসা না করে পারেন নি। যেমন:-
- গীবনের ডিক্লাইন এন্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার,
- উইলিয়াম ম্যুইরের লাইফ অব মোহম্মদ এবং দ্যা খেলাফত
- স্টেইনলি লেনপুলের দ্যা মুরস ইন স্পেন,
- ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর ইসলাম: এ শর্ট হিস্টোরি,
- ইরা এম ল্যাপিডাস এর আ হিস্টোরি অফ ইসলামিক সোসাইটিস,
- আর্নল্ডের দ্যা প্রিচিং অব ইসলাম,
- ড্রাপারের ইন্টেলেকচুয়াল ডেভলপমেন্ট অব ইউরোপ,
- জনসনের ওরিয়েন্টাল রিলিজিয়ন্স,
- পি. কে. হিট্টির দ্যা অ্যারাব্স,
- ওসবোর্নের ইসলাম আন্ডার দ্যা অ্যারাবস্
ইত্যাদি ইউরোপীয় ভাষায় লিখিত বইগুলোতে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। মুসলিম ঐতিহাসিক সৈয়দ আমির আলীর লেখা “এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ স্যারাসিনস” বইয়ের পাতা থেকে খুঁজে বের করা যাক ইতিহাসের উজ্জ্বল দিনগুলো।
মদিনায় রসুলাল্লাহর (সা.) জীবনের দশ বছর অতিবাহনকালে আরবের দাঙ্গাপ্রিয় গোত্রগুলো এক মহান আদর্শে প্রভাবিত হয়ে দ্রুত একটি সংঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন এই কাজ মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর কীর্তি হিসাবে অমর হয়ে থাকবে চিরকাল। খোলাফায়ে রাশেদুনের ত্রিশ বছরের শাসন আরবদের মধ্যে নিয়ে আসে বিস্ময়কর পরিবর্তন।
খলিফাই ছিলেন সরকারের সর্বময়কর্তা। তাঁকে সাহায্য করত রসুলাল্লাহর (সা.) ঘনিষ্ঠ সাহাবিদের নিয়ে গঠিত একটি অভিজ্ঞ মন্ত্রণা পরিষদ। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রপ্রধানদের সঙ্গে নিয়ে প্রায়শই অধিবেশন বসত মসজিদে নববীতে। রসুলাল্লাহর সাহাবিদেরকে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমন আবু বকরের (রা.) খেলাফতকালে বিচার ও যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পান ওমর (রা.)। আলী (রা.) কে দেওয়া হয় যোগাযোগ, যুদ্ধবন্দীদের তত্ত্বাবধান, তাদের চিকিৎসা ও মুক্তিপণের দায়িত্ব। আরেক সাহাবি সৈন্যবাহিনীর সাজ সরঞ্জামের তদারকি করতেন।
ত্রিশ বৎসরব্যাপী স্থায়ী খেলাফতের শাসন প্রণালি বিশিষ্ট রূপ লাভ করেছিল ওমরের (রা.) জীবদ্দশায় ও তাঁর শাহাদাত পরবর্তীকালে। বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলমান ছিল। একেকটি যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের জীবনের লক্ষ্য পূরণে। বিজিত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করে চলছিল আল্লাহর দীন। উম্মাহ যেন তাদের জীবনের লক্ষ্য ভুলে না যায় সেজন্য ওমর (রা.) তাঁর সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য কোনো বিজিত এলাকায় জমি ক্রয় করা নিষিদ্ধ করে দেন। তাঁর নিয়োজিত প্রশাসকদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত ছিল যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে ধনী ও দরিদ্র সবাই সমান এবং তাদেরকে অরাজকতা থেকে রক্ষা করতে মুসলিম শাসনকর্তারা আল্লাহর প্রতিনিধিমাত্র। রাষ্ট্রের রাজস্ব খলিফার উপকার বা তাঁর সমৃদ্ধি সাধনের জন্য নয় – জনকল্যাণের জন্য। দারিদ্র্য দূর করার জন্য ধনীদের যাকাত প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছিল ন্যায়বিচার ও করুণার অঙ্গীকার। ফলে ওমরের (রা.) খেলাফতকালে কোষাগারের জন্য কোনো প্রহরী এমন কি হিসাব বইয়েরও প্রয়োজন হতো না। যাকাত, সদকা যেমন পাওয়া যেত তেমনই তা বিতরণ করা হতো দরিদ্রদের মধ্যে, অথবা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের কাজে। যুদ্ধলব্ধ মালপত্রও অনুরূপভাবে বিতরিত হতো, ন্যায়সঙ্গতভাবে- বৃদ্ধ, যুবক, স্ত্রী, পুরুষ, মনিব, খাদেম নির্বিশেষে। রাজস্ব থেকে গোটা জাতিই মাত্রানুযায়ী ভাতা বা বৃত্তিলাভের অধিকারী হতো। এই সুবিধা কেবল মুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। খেলাফতের অনুগত ও বিশ্বস্ত অমুসলিম প্রজারাও অনুরূপ বিবেচনা লাভ করত।
শুরুতে জনগণই সাধারণত পুলিশের দায়িত্ব পালন করত। তবে জনসেবার পরিধি বাড়াতে ওমর (রা.) নৈশ প্রহরা ও চৌকি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, তিনি নিজেও রাত জেগে মদীনার পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন কারো কোনো অসুবিধা আছে কিনা দেখার জন্য। তবে নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা আলী (রা.) এর খেলাফতের আগে হয় নি, কারণ খলিফা ওসমানের (রা.) হত্যাকা-ের দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর সময়ে জাতির মধ্যে বিদ্রোহী ও মোনাফেকদের তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি ‘সুরতা’ নামে পৌররক্ষী বাহিনী গঠন করেন যার প্রধান অভিহিত হতেন “শাহিব-উস-সুরতা” নামে। তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণ ও নিরাপদ তত্ত্বাবধানের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় আর্কাইভ বা মহাফেজখানাও প্রতিষ্ঠা করেন।
অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে মক্কা যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে আকৃষ্ট হয়, তখন মদীনাবাসীরা উন্নতির জন্য নির্ভর করত তাদের জমি সম্পত্তির উপর। রসুলাল্লাহর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ও প্রশিক্ষণের প্রভাবে মদীনার জনগণের মানসিকতা ও জীবনযাপনে ইসলামের প্রতিফলন ঘটেছিল সবচেয়ে অধিক। তারা তাদের জীবনকে অন্যান্যদের তুলনায় অধিকতর গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণের জন্য অন্যান্য এলাকা থেকে বিদ্যার্থীরা আসতেন মদীনায়। রসুলাল্লাহর সাহাবীরা তাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত আকিদা তুলে ধরতেন, হাতে কলমে শিক্ষা দিতেন। সেখানকার বক্তৃতাকক্ষগুলো উৎসাহী ছাত্রে ভরে উঠত।
আরবের মুসলিম নারীদের প্রধান পোশাক ছিল একটি ঢিলেঢালা লম্বা জামা। বাইরে যাওয়ার সময় এর উপর আরেকটা ঢিলা পোশাক পরা হতো, যা টেনে চেহারাকে আড়াল করা যেত কিংবা কাপড় চোপড়কে রক্ষা করা যেত ধুলো বা কাদা থেকে। মেয়েরা তখন ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। বহু মুসলিম দেশে যে পর্দাপ্রথার প্রচলন রয়েছে তা খুব বেশি আগে চালু হয় নি। প্রকৃত ইসলামের যুগে মুসলিম নারীরা স্বাধীনভাবে বাইরে চলাফেরা করতেন। শুনতে যেতেন খলিফাদের ধর্মোপদেশ এবং আলী (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.) সহ অন্যান্যদের বক্তৃতা। এটি ছিল মদীনার দৈনন্দিন দৃশ্য। দিবসের পরিশ্রমের পর গান গাওয়া এবং বাঁশি, দফ ও তাম্বুরা (আধুনিক গিটারের পূর্বরূপ) বাজানো ছিল মদীনাবাসীর প্রধান চিত্তবিনোদন। উত্তর শহরের মহিলারা সুগায়িকা ছিলেন এবং ঐতিহাসিকদের মতে কঠোর প্রকৃতির ওমর (রা.) পর্যন্ত টহলদারির সময় প্রায়শই তাদের গান শুনে দাঁড়িয়ে যেতেন।
আরব উপদ্বীপে শাসনাধিকার কায়েমের পর রসুলাল্লাহ (সা.) সমস্ত প্রধান নগর ও প্রদেশগুলোতে ‘আমির’ আখ্যাধারী শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর শাসনকর্তাকে বলা হতো ‘ওয়ালি বা নায়িব’ (সহকারী)। অধিকাংশ স্থানে শাসনকর্তাই তার পদাধিকার বলে জুমার সালাতে এমামতি করতেন এবং খোতবা দান করতেন, প্রায়শই যে খোতবা হয়ে উঠত সমসাময়িক রাজনৈতিক ইশতেহার। ‘দিওয়ান’ নামে একটি অর্থ বিভাগও গড়ে তোলেন রাজস্ব আদায় ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করতে। শাসনকর্তা ছিলেন প্রদেশের একাধারে সামরিক ও অসামরিক বিভাগের প্রধান। অধিকৃত দেশসমূহের প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো কৃষক সম্প্রদায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। সে উদ্দেশ্যে মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও দক্ষিণ পারস্যে ভূমি জরিপ করা হয় এবং রাজস্বও ধার্য করা হয় সমানুপাতিক হারে। ব্যাবিলনে জালের মতো অনেকগুলো খাল খনন করা হয় এবং টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর বাঁধ পুনর্নির্মাণ করা হয়।
সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য পরিচালনা ও সালাতে এমামতির জন্য ওমর (রা.) স্বয়ং ফিলিস্তিন, দামেস্ক, হেমস ও কিন্নিসরিনে বিশেষ বিচারকম-লী নিয়োগ করেন। বিচারপতিগণ স্থানীয় শাসনকর্তাদের অধীন ছিলেন না। বিচারপতি অর্থাৎ কাজীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ‘হাকিম’ উপাধি। বিচারকার্যের ক্ষেত্রে সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হতো এবং খলিফাগণ নিজেরাই সমতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিচারকার্যের ক্ষেত্রে বিচারপতির আদেশ মান্য করে।
গোত্রীয় পুরুষদেরকে নিয়েই মূলত সৈন্যবাহিনী গঠিত হতো এবং মদিনা, তায়েফসহ অন্যান্য নগরী থেকে জেহাদে যোগদানের জন্য সৈন্য সংগ্রহ করা হতো। খলিফা স্বয়ং বা তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে মসজিদসমূহে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি বর্ণনা করতেন এবং জাতির সদস্যদেরকে জ্বালাময়ী বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন আল্লাহর রাস্তায় বহির্গত হওয়ার জন্য। যাকাত, জিজিয়া ইত্যাদি রাজস্ব কর থেকে সৈন্যদের বেতন দেওয়া হতো। যেহেতু সেনাবাহিনীর প্রধান খলিফার প্রতিনিধিত্ব করতেন, সেহেতু তিনিই সালাতের এমামতি করতেন। শৃঙ্খলাভঙ্গ ও যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতার জন্য শাস্তি দেওয়া হতো ‘পিলোরি’ যন্ত্রের সাহায্যে। কাঠের নির্মিত এই যন্ত্রে দ-িত ব্যক্তির হাত, পা ও মাথা আটকানোর ছিদ্র থাকতো। আরেকটি শাস্তি ছিল সৈনিকের মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ বা পাগড়ি খুলে নেওয়া। মুসলিম সৈনিকদের জন্য এসব শাস্তি এতই মানহানিকর ছিল যে তাতে সম্পূর্ণভাবেই অভিষ্ট ফল পাওয়া যেত।
সৈন্যদলে থাকতো অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী। অশ্বারোহীদের হাতে থাকতো ঢাল, তলোয়ার ও লম্বা বর্শা। পদাতিকদের কাছে থাকতো ঢাল, তলোয়ার, বর্শা বা তীর-ধনুক। যুদ্ধের প্রারম্ভে সেনাবিন্যাস করে ব্যুহ রচনা করা হতো। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সামনের সারিতে পদাতিক বাহিনীর বর্শাধারীরা থাকতো। তাদের পেছনে থাকতো তীরন্দাজগণ। আর অশ্বারোহী বাহিনী দুই পাশেই থাকতো। যুদ্ধ শুরু হতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে। মুসলিম সৈন্যদের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে ছিল তাদের ক্ষিপ্রগতি, প্রত্যয়, কষ্ট সহ্য করার অমানবিক ক্ষমতা। প্রথম দিকে তারা দূরপাল্লার অভিযানে যেত উটের পিঠে চড়ে। সৈন্যরা শিবির স্থাপনের জন্য খেজুর পাতার কুড়েঘর তৈরি করত। কিন্তু পরবর্তীকালে ওমর (রা.) সেনানিবাস স্থাপনের নির্দেশ দেন। এভাবেই ইরাকের বসরা, মিশরের ফুসতাত, তিউনিশিয়ার কায়রোয়ান, সিন্ধুর মনসুরা প্রভৃতিতে ফৌজি ঘাঁটি বা গ্যারিসনের উদ্ভব হয়। অন্যান্য স্থানে হেমস, গাজা, এডেসা, ইস্পাহান ও আলেকজান্ড্রিয়ার রেবাত বা ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বিরাট সৈন্যবাহিনী রাখা হতো আকস্মিক আক্রমণ রুখে দিতে। মুসলিম সৈন্যরা কোর’আনের আয়াত পাঠ করতে করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করত এবং আক্রমণ হানতো উচ্চৈঃস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ অথবা ‘দীন’ ‘দীন’ শব্দের নিনাদ তুলে। দামামা ও নাকাড়া অর্থাৎ ব্যাটেল ড্রামের প্রচলন ছিল যার দ্রিম দ্রিম আওয়াজ শত্রুর অন্তরাত্মা প্রকম্পিত করে তুলত। গোত্রীয় সৈন্যরা আসতো সপরিবারে, নারী-শিশু সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। দুর্গনগরী ও সেনাঘাঁটিগুলোতে তাদের থাকার জন্য আলাদা কোয়ার্টার থাকতো। যেসব মোজাহিদ পরিবার রেখে আসতো তাদের চারমাস অন্তর ছুটি দেওয়া হতো বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরববাসীরা বহু স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত ছিল। এটি ছিল গোত্রীয় যুদ্ধে পুরুষ মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার স্বাভাবিক পরিণাম। অন্যথায় স্ত্রী লোকদের না খেয়ে মরতে হতো বা অসম্মানের পথ বেছে নিতে হতো। রসুলাল্লাহ এই প্রথাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং বহুবিবাহকে করে তোলেন সমাজের সর্বস্তরের উপযোগী। নারীকে বিলাস-ব্যসনের সামগ্রী হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এতে করে পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পেলেও নারীদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। মুসলিম সমাজে পরিবারগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক এবং পারিবারিক বন্ধন ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। দাস কেনাবেচা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবে যেসব লোক আইনসম্মতভাবে যুদ্ধবন্দী হতো, একমাত্র তাদেরই মুক্তিপণ না দেওয়া পর্যন্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তির সেবক হিসাবে রাখার অনুমতি প্রদান করা হতো। তবে সেখানেও তারা পরিবারের অন্যান্য লোকদের মতোই মর্যাদা পেত।
আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর অনুসারীরা যে সমাজব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমরা এখানে তাদের সেই জীবনের নানা অঙ্গনের বিক্ষিপ্ত কিছু ছবি আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। যারা দৃষ্টিবান ও যুক্তিবোধ সম্পন্ন তারা আশা করি বুঝতে পারবেন যে, আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে শত শত বছর ধরে যে ইসলাম শেখানো হচ্ছে তা উম্মতে মোহাম্মদীর অনুসৃত ইসলামের সাথে অসাঞ্জশ্যপূর্ণ। সেই ইসলাম জন্ম দিয়েছিল এমন এক অপরাজেয় যোদ্ধা জাতির যারা কালের অন্ত অবধি শ্রেষ্ঠ সামরিক প্রতিভাবান দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপে গণ্য হবে। তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল এমন এক সভ্যতা যার অনুপ্রেরণা সমগ্র মানবজাতির জীবনকে কেবল প্রভাবিতই করে নি, আলোড়িত করেছিল, প্রচ- শক্তিতে পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিলো। জীবনের প্রতিটি পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিল সমৃদ্ধির সুধারসে। আর আজকের মাদ্রাসাগুলোতে ইসলাম শিখে যারা আলেম নাম ধারণ করে বেরিয়ে আসছেন তারা ইসলামকে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বদলে ধর্মকে পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করাকেই পরম কর্তব্য বলে মনে করছেন। তাদের ওয়াজ, বক্তৃতার বিষয়বস্তু হলো পরকাল, কোন আমলে কত সওয়াব মিলবে, ভিন্ন ফেরকার আলেমদের বিষোদ্গার করা ইত্যাদি। জাগতিক জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব কর্তৃত্ব লাভের স্বপ্নও তারা দেখেন না, তাদের অধিকাংশের স্বপ্ন একটা মসজিদে ভালো বেতনে ইমামতির চাকরি। সমাজের অসৎপন্থী নেতাদের সামান্য সোহবত, নৈকট্য পেলেই তারা বিগলিত হয়ে যান। মুসলিম জাতির নিদারুণ পরাজয় ও করুণ দুরবস্থা নিয়ে তাদের কিছুই কর্তব্য নেই। কারণ ওটা দূর করার দায়িত্ব তো তাদের নয়, এজন্য ইমাম মাহদি (আ.) ও ঈসা (আ.) যথাসময়ে আবির্ভূত হবেন। তখন তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ঘনিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পথে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব লাভ করার সুখস্বপ্ন তারা অবসর পেলে দেখেন। তারা কাল্পনিক মন্ত্রী সভা তৈরি করেন। মাদ্রাসার গদিতে কিংবা মাহফিলের কুরসিতে আসীন হয়ে তারা নিজেদেরকে মুসলিম জাতির বাদশাহ বলে ভুল করেন। পৃথিবীতে যে আল্লাহর হুকুম চলে না, সেটাও তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। কারণ আল্লাহর হুকুম না মানলেও, কোর’আনকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যের তৈরি হুকুম বিধান মানলেও অনায়াসে মুসলিম থাকা যায় – এমন শিক্ষাই তারা জাতিকে দিয়ে থাকেন। ফলে শাসনের আসনে ইবলিস যুগ যুগ ধরে থাকলেও ধর্মব্যবসায়ীদের আদর-কদর দিব্যি চলছে। তাদের বদৌলতে উম্মতে মোহাম্মদীর তলোয়ারের জায়গা করে আজকে করে নিয়েছে তসবিহ, শিরস্ত্রাণের বদলে টুপি, যুদ্ধনিনাদের বদলে জিকির, বর্শার বদলে ভিক্ষাপাত্র, শাসনের বদলে গোলামি, সম্মানের বদলে সকল জাতির ঘৃণাই এখন তাদের সম্বল। যাদের বাস ছিল সৈন্যশিবিরে আজ তারা ভিক্ষাপাত্র সম্বল করে উদ্বাস্তু শিবিরে। কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন-
স্ত্রী পুত্রে আল্লাহরে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
হেসে কোরবানী দিত প্রাণ, হায়! আজ তারা মাগে ভিখ।
[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ। যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭৮৭৬৮২০২৫]