■ মোহাম্মদ আসাদ আলী
আখেরী নবীর ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে সবচাইতে গুরুতর ও তাৎপর্যপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে দাজ্জালের বিষয়ে, যার ফেতনা থেকে রসুল (সা.) নিজেই পানাহ চেয়েছিলেন আল্লাহর কাছে। কিন্তু এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুসলিম জাতির অসচেতনতা ও অন্ধত্বের পরিণতি দাঁড়িয়েছে এই যে, ইতোমধ্যেই দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করে সমগ্র মানবজাতিকে দিয়ে আল্লাহর রব্যুবিয়াত ও উলুহিয়্যাত অস্বীকার করিয়ে নিজেকে রব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে এবং মুসলিম নামধারী জাতিটিসহ সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ¯্রষ্টাহীন সভ্যতাই সেই দাজ্জাল যাকে আল্লাহর রসুল রূপকভাবে বর্ণনা করে গেছেন।
১৫৩৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ৮ম হেনরির রাজত্বকালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, মানুষের জাতীয় জীবনে আর ধর্মের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, ধর্মকে যদি সম্ভব হয় পুরোপুরি মানবজীবন থেকে বিতাড়িত করে ফেলা হবে, আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে জাতীয় জীবন থেকে অপসারণ করে কেবল মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হবে। রাষ্ট্রকে এই ধর্মহীনকরণের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল দাজ্জালের অর্থাৎ একটি ধর্মহীন আত্মাহীন জড়বাদী সভ্যতার। এরপর বিগত কয়েকশ’ বছরের পরিক্রমায় শৈশব কৈশোর পার হয়ে এই দানব এখন যৌবনে উপনীত হয়েছে, সারা পৃথিবী এখন এই ¯্রষ্টাহীন, আত্মাহীন বস্তুবাদী সভ্যতার পায়ে সেজদাবনত হয়ে আছে যেমনটা হাদীসের বর্ণনায় পাই।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বদাই মানুষ বিকৃতভাবে হলেও আল্লাহর হুকুম-বিধান মেনে এসেছে, রাজা ও পুরোহিতরা কখনও কখনও নিজেদের মনগড়া বিধান দিয়েছে কিন্তু সেটাকেও আল্লাহর বিধান বলেই চালানো হয়েছে, কখনই মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের চলার পথ নিজেরাই রচনা করে নেওয়ার মত চরম ধৃষ্টতা দেখায় নি। কিন্তু পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতার জন্মই হলো আল্লাহকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে, আল্লাহর হুকুম-বিধানকে বাতিল করে দিয়ে, আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌমত্ব মানুষের নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে। এর চেয়ে গুরুতর ও সংকটজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? স্বভাবতই এই ঘটনার পরিণতিও ভয়াবহতার সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অন্য কিছু বাদ দিলেও এই আল্লাহহীন, আত্মাহীন পশ্চিমা জড়বাদী সভ্যতা মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে যে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়ে ১৩ কোটি বনি আদমের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং বর্তমানে সারা পৃথিবীকে ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে সেটাকেও নিঃসংশয়ে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বা সংকট বললে ভুল হয় না। আর এজন্যই হাদীসে দাজ্জালের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত দাজ্জালের চেয়ে বড় কিছু ঘটবে না (মুসলিম)।’ এই সভ্যতা আপাতদৃষ্টিতে খৃষ্টীয় সমাজে জন্মগ্রহণ করেছে বলে মনে হলেও আদতে খৃষ্টানিটি ধর্মের গোড়াও ইহুদি ধর্মে প্রোথিত। তাই আল্লাহর রসুল বলেন, ‘দাজ্জাল ইহুদি জাতির মধ্য থেকে উত্থিত হবে এবং ইহুদি ও মোনাফেকরা তার অনুসারী হবে (মুসলিম)।’ মোনাফেক বলতে ঐসমস্ত নামধারী মুসলিমকে বুঝিয়েছেন যারা একদিকে প্রতিনিয়ত সাক্ষ্য দিচ্ছেন আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (হুকুমদাতা) নেই, অন্যদিকে আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় জীবনে দাজ্জালের তৈরি হুকুম-বিধান মেনে নিয়েছেন। এমন দ্বিমুখী নীতি অবশ্যই মোনাফেকের চরিত্র।
আজকে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা কার্যত মানবজাতির রবের ভূমিকায় উপনীত হয়েছে। তার দাবি হচ্ছে, ‘তোমরা যে যার মত ধর্মকর্ম কর আমার আপত্তি নাই, কিন্তু সেটা যেন ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভুলেও জাতীয় জীবনে আল্লাহ, রসুল, ধর্মকে টেনে এনো না। সেখানে কেবল আমার হুকুম-বিধান চলবে।’ দাজ্জালের এই দাবির কথাও আল্লাহর রসুল বলে গেছেন আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বেই। তিনি বলেন, ‘দাজ্জাল নিজেকে মানুষের রব বলে ঘোষণা করবে এবং মানবজাতিকে বলবে তাকে রব বলে স্বীকার করে নিতে (বোখারী)।’
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এই সভ্যতা নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে এই সভ্যতা পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে সব জানতে পারছে। পৃথিবীর একপ্রান্তে কিছু হলে মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ছে অপর প্রান্তে। এই শ্রবণক্ষমতা বোঝানোর জন্য আল্লাহর রসুল বলেন, ‘দাজ্জালের বাহনের দুই কানের মধ্যে দূরত্ব হবে সত্তর হাত (বায়হাকী, মেশকাত)।’ আরবিতে সত্তর বলতে অসংখ্য বোঝায়। অর্থাৎ বোঝানো হচ্ছে দাজ্জালের বাহনের দুই কানের মধ্যে অসংখ্য দূরত্ব থাকবে। আসলে কথাটি রূপক অর্থে বলা হয়েছে যা থেকে বোঝা যায় দাজ্জাল দূর-দূরান্তের খবরও জানতে পারবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি এরোপ্লেন যখন আকাশ দিয়ে উড়ে যায় তখন সেটাকে বায়ুতাড়িত অর্থাৎ জোর বাতাসে চালিত মেঘের টুকরোর মত দেখায়। তাই রসুল বলেন, ‘দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। বায়ুতাড়িত মেঘের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চলবে (মুসলিম, তিরমিযি)।’ মেঘে রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে বৃষ্টি বর্ষণের ঘটনা প্রায়ই পত্র-পত্রিকা মারফতে জানতে পারি আমরা। এ কথাটি রসুল বলে গেছেন যে, ‘দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে (প্রাগুক্ত)।’ তথ্যাভিজ্ঞ প্রতিটি লোকই জানেন যে, ইউরোপ, আমেরিকায় অর্থাৎ পাশ্চাত্য জগতের ঈধঃঃষব অর্থাৎ গরু-মহিষ-বকরি ইত্যাদির আকার বাকি দুনিয়ার ঐসব গৃহপালিত পশুর চেয়ে অনেক বড়, চার-পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি দুধ দেয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি দিয়ে এই অসম্ভবটি সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়েও আল্লাহর রসুল বলেন, ‘দাজ্জালের গরু-গাভী, মহিষ, বকরি, ভেড়া, মেষ ইত্যাদি বড়বড় আকারের হবে এবং সেগুলোর স্তনের বোটা বড় বড় হবে (যা থেকে প্রচুর দুধ হবে) (প্রাগুক্ত)।’ এক শতাব্দী পূর্বেও যেখানে মানুষ মাটির নিচের সম্পদ তুলে আনা তো দূরের কথা, এই সম্পর্কে খুবই সীমিত ধারণা রাখত, আজকে এই সভ্যতা আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই সেই সম্পদকে হস্তগত করছে ও সুবিধামত ব্যবহার করছে। এ কথাটিই আমরা পাই হাদীসে এইভাবে যে, ‘দাজ্জাল মাটির নিচের সম্পদকে আদেশ করবে ওপরে উঠে আসার জন্য এবং সম্পদগুলো ওপরে উঠে আসবে এবং দাজ্জালের অনুসরণ করবে (প্রাগুক্ত)।’
ইহুদি-খ্রিস্টান বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা জীবনের ভারসাম্যের একটা দিক, আত্মার দিক, পরকালের দিক, অদৃশ্যের (গায়েব) দিক, সত্যের দিক দেখতে পায় না, তার সমস্ত কর্মকা- জীবনের শুধু একটা দিক নিয়ে, দেহের দিক, জড় ও বস্তুর দিক, যন্ত্র ও যন্ত্রের প্রযুক্তির দিক, ইহকালের দিক। তাই বিশ্বনবী বলেছেন, দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ হবে (বোখারী, মুসলিম) অর্থাৎ সে কেবল একটি দিক দেখতে পাবে, যেটা বাম চোখ দিয়ে দেখা যায়। এই ইহুদি-খ্রিস্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে তার বাঁ চোখ দিয়ে এই মহাবিশ্ব, এই বিশাল সৃষ্টিকে দেখতে পায়। কিন্তু তার ডান চোখ অন্ধ বলে এই সৃষ্টির স্রষ্টাকে দেখতে পায় না; অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে বিশাল মহাকাশ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বস্তু যে এক অলংঘনীয় বিধানে বাঁধা আছে তা দাজ্জাল তার বাঁ চোখ দিয়ে দেখতে পায়, কিন্তু ডান চোখ নেই বলে এই মহাবিধানের বিধাতাকে দেখতে পায় না। শিশুর জন্মের আগেই মায়ের বুকে তার খাবারের ব্যবস্থা করা আছে তা দাজ্জালের চিকিৎসা বিজ্ঞান তার বাঁ চোখ দিয়ে দেখতে পায়, কিন্তু যিনি এ ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেই মহাব্যবস্থাপককে সে দেখতে পায় না, কারণ তার ডান চোখ অন্ধ।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কি তবে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রপাতি, যানবাহন, তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদিকে দাজ্জাল বলছি? মোটেও কিন্তু তা নয়। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিই দাজ্জাল নয়, দাজ্জালের বাহনমাত্র। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি নিজে ভালো বা মন্দ হতে পারে না, ভালো বা মন্দ হতে পারে সেগুলোর ব্যবহার। একটি অস্ত্র দিয়ে নিরীহ মানুষ খুন করা যায়, আবার নিরীহ একজন মানুষকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচানোও যায়, এতে অস্ত্রের কোনো দায় নেই, দায় সেই অস্ত্রের ব্যবহারকারীর। পাশ্চাত্য সভ্যতা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে বলে তো আর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিই নাজায়েজ হয়ে যেতে পারে না।
পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা আজকে সমস্ত পৃথিবীর স্থলভাগ ও সমুদ্র আচ্ছন্ন করে আছে। সারা পৃথিবীকে এই সভ্যতা তার হাতের মুঠোয় পুরে রেখেছে। তার ইচ্ছার বাইরে যায় এমন কোনো শক্তি নেই। এ ব্যাপারে আল্লাহর রসুল বলেন, ‘দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি পৃথিবীর সমস্ত মাটি ও পানি আচ্ছন্ন করবে। সমস্ত পৃথিবী চামড়া দিয়ে জড়ানো একটি বস্তুর মত তার করায়ত্ত হবে (মুসনাদে আহমদ)।’
মানুষ শান্তি ও সমৃদ্ধির উপায় তালাশ করে, স্বর্গসুখের স্বপ্ন দেখে। এই ¯্রষ্টাহীন সভ্যতা তাদেরকে বলছে- শান্তি তার কাছে আছে। মানুষের জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর হুকুমকে নির্বাসন দেওয়ার পর এই সভ্যতা যে ধর্মহীন আত্মাহীন জীবনব্যবস্থাগুলো তৈরি করেছে সেগুলোই মানুষকে স্বর্গসুখ দিতে সক্ষম। দুর্ভাগ্যবশত মানবজাতি বারবার পাশ্চাত্য সভ্যতার এই আশ্বাসবাণী বিশ্বাস করেছে এবং ঠকেছে। যেমন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর বলা হয়েছিল স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই দেখা গেল সেই স্বর্গরাজ্য থেকে পালাবার জন্য মানুষ জীবন বাজি রাখছে। বর্তমানে এই সভ্যতা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়াচ্ছে পৃথিবীময়, আর মানুষকে বোঝাচ্ছে স্বর্গসুখ আছে একমাত্র এই ব্যবস্থায়। সেই স্বর্গসুখও যে বাস্তবে নরকযন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে তা পৃথিবীর দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ছয় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু। খাবারের অভাবে প্রাণের ঝুঁকিতে ধুকছে কোটি কোটি বনি আদম। অথচ পৃথিবীতে সম্পদের অভাব নেই। এই গ্রহেরই এমন রাষ্ট্র আছে যার রাষ্ট্রপ্রধানরা টাকা খরচ করবেন কোথায় তা ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু ২০১৬ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, হিসাব করে দেখা যাচ্ছে এই টাকায় ৩৮৩ বার আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ দূর করা সম্ভব হতো। একদিকে মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার দিয়ে মানুষকেই মারার অস্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে, এই হচ্ছে এই সভ্যতার স্বর্গসুখ, জান্নাত।
অন্যদিকে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা দিবারাত্রি যেই ধর্মকে অশান্তি (জাহান্নাম) ও নিপীড়নের কল বলে অপপ্রচার চালায় সেই ধর্মের শাসন এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল যে মানুষ দরজা খুলে ঘুমাত, স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে মসজিদে নামাজ পড়তে যেত, কেউ অপরাধ করলে নিজেই নিজের বিচার দাবি করত! ইসলামের স্বর্ণযুগে মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত দেবার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, কিন্তু গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। শহরে-বন্দরে লোক না পেয়ে অনেকে উটের পিঠে মালামাল চাপিয়ে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াত যাকাত গ্রহণকারীর সন্ধানে। এগুলো ইতিহাস। অর্থাৎ দেখা গেল পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা যেটাকে বলল স্বর্গ সেটা আসলে নরক, আর যেটাকে বলা হলো নরক, সেটাই যুগ যুগ ধরে মানুষকে স্বর্গসুখ দিয়ে এসেছে, আজও দিতে সক্ষম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে- ঠিক এই কথাটিই আল্লাহর রসুল বলে গেছেন যে, ‘‘দাজ্জাল যেটাকে জান্নাত বলবে সেটা আসলে হবে জাহান্নাম, আর সে যেটাকে জাহান্নাম বলবে সেটা আসলে হবে জান্নাত। তোমরা যদি তার (দাজ্জালের) সময় পাও তবে দাজ্জাল যেটাকে জাহান্নাম বলবে তাতে পতিত হয়ো, সেটা তোমাদের জন্য জান্নাত হবে। [আবু হোরায়রা (রা.) এবং আবু হোযায়ফা (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম]
কিন্তু আজ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মিথ্যাবাদী প্রতারক দাজ্জাল যেটাকে জান্নাত বলেছে সেটাকেই এই জাতি পরম ভক্তির সাথে গ্রহণ করে নিয়েছে। আর তার পরিণতিতে পাশ্চাত্যের এই বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা ইতোমধ্যেই মানবজাতিকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তবু দাজ্জালের সৃষ্ট মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। কেউ যদি দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনিয়েও দেয়, এই জাতির ধর্মগুরুরা তাতে বিরক্ত হন, বিক্ষুব্ধ হন, ফুঁসে উঠে তেড়ে আসেন- ‘‘কী! আমরা তার মানে দাজ্জালের অনুসারী! আমরা এই এত এত নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, হজ্ব করতে যাচ্ছি, মিলাদ করছি, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাত করছি! এসব চোখে পড়ছে না তোমার?’’ তাদের জন্যই হয়ত আল্লাহর রসুল বলে গেছেন, ‘দাজ্জালের দুই চোখের মাঝখানে কাফের লেখা থাকবে। কেবল মো’মেনরাই তা দেখতে ও পড়তে পারবে। মো’মেন না হলে পড়তে পারবে না (বোখারী, মুসলিম)।’
এই হাদীসে আল্লাহর রসুল বললেন না দাজ্জালের কপালের কাফের লেখা কেবল নামাজীরাই পড়তে পারবেন, বললেন না হাজ্বীরাই পড়তে পারবেন, এও বললেন না যে ওলামা, মাশায়েখ, মোহাদ্দীস, মোফাসসির, মাওলানা সাহেবরা পড়তে পারবেন। বললেন নির্দিষ্ট করে কেবল মো’মেনদের কথা। কাজেই দাজ্জালকে চিনতে হলে অবশ্যই মো’মেন হতে হবে। যারা মো’মেন তারা ঠিকই এই সভ্যতার মুখোশের অন্তরালের কুৎসিত দানবীয় চেহারাটি চিনে ফেলবেন এবং যথাসাধ্য প্রতিরোধ করবেন। কিন্তু এই যে মানুষগুলো বলছেন যে, এটা দাজ্জাল নয়, দাজ্জাল অন্য কেউ, তাদের প্রতি প্রশ্ন হচ্ছে- এটাকে দাজ্জাল মনে হচ্ছে না বলেই কি আপনি এই প্রতারক সভ্যতাকে প্রতিরোধ করবেন না? এই সভ্যতার বিষাক্ত ছোবল থেকে মানুষকে বাঁচাবেন না? দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়েছে এই সভ্যতা। তাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা ইতিহাস হয়ে আছে। এবার যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যদি এই সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সবচাইতে ভয়াবহ অপব্যবহারটি অর্থাৎ পরমাণু অস্ত্রগুলো একের পর এক আছড়ে পড়তে থাকে আমাদের এই ধরিত্রীর বুকে, তবে পুরো মানবজাতি এখনই বিনাশ হয়ে যাবে। পৃথিবী নামক গ্রহটিই ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি বসে আছেন যে দানবের আশায়, পৃথিবীই যদি না থাকে তাহলে সেই দানব আসবে কোথায়? কাজেই এখনই সময় পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী এই যান্ত্রিক সভ্যতার দাজ্জালীয় তা-ব থেকে নিজেকে, জাতিকে ও ভবিষ্যৎ বংশধরকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হবার। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই যাবতীয় অন্যায়, অসত্য ও দাজ্জালীয় তা-বের বিরুদ্ধে।