আতাহার হোসাইন
করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে তার তা-ব অব্যাহত রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে করোনা দূর হবে কি না এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান। তবে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে করোনারোধী টিকা আবিষ্কারের জন্য। বিশ্ববাসী আশা করছেন আগামী বছরের শুরুতেই হয়তো করোনাভাইরাসের টিকা হাতে পাওয়া যাবে। গবেষকদের দিনরাত প্রচেষ্টা ও অর্থব্যয় সকলকে এ আশাবাদে সাহস যোগাচ্ছে। তবে এই অবস্থা থেকে কখন মুক্তি মিলবে নিশ্চিত করে তার কোনো ধারণা কেউ দিতে পারছেন না।
গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস খুব দ্রুত সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের মার্চের দিকে মোটামুটি সব দেশেই অল্পবিস্তর ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হতে থাকে। সংক্রমণ রোধে চীনের উহানের মতোই লকডাউনকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে অধিকাংশ দেশ। লকডাউনের ফলে মুহূর্তে সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের গণপরিবহন ও বিমান চলাচল ব্যবস্থা। প্রতিটি রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। একসাথে অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ বন্দী হয়ে পড়েন ঘরে। মানবজাতির ইতিহাসে এ ঘটনার নজীর নেই বলা চলে।
একসাথে পৃথিবীর প্রায় সকল অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে চিন্তা করে অনেক চিন্তাশীলই দিশেহারা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যদি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণেও এসে যায় তবে ইতোমধ্যে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা সামলাতে বিশ্বকে আরো বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে গবেষকগণ মত দিচ্ছেন। মূলত অর্থনৈতিক ক্ষতিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব্যব্যবস্থায় আরো নানা ধরনের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করছেন তারা। অনেকে বলছেন, করোনাভাইরাস পুরো ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করবে। যেহেতু সকল পরিবর্তনের মূলে কাজ করে অর্থনীতি, সেহেতু আমাদের আজকের আলোচনার কেন্দ্র থাকবে অর্থনৈতিক সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে।
আমাদের বিশ্ব তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শেষে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে পা রাখছিল। যোগাযোগ ও তথ্য- প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল সমগ্র বিশ্ব। গ্লোবালাইজেশনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ সভ্যতা। এরই মধ্যে হঠাৎ করে এ স্তব্ধতা সকল সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গত কয়েক মাসে বিশ্ব অর্থনীতিতে যা ঘটেছে সেটা এক নজরে দেখে নেয়া যাক। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চাইতেও ভয়াবহ। কেউ কেউ বলছে ১৯৩০ এর দশকে যে বিশ্ব মহামন্দার সূচনা হয়েছিল, এবারের অর্থনৈতিক সংকট সেটাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার বিশ শতাংশ পড়তে সময় লেগেছে মাত্র ১৫দিন। এত দ্রুত আর কখনো মার্কিন শেয়ার বাজার এতটা পড়েনি। বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ারী দিয়েছেন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভ মানচিন। এর মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন কাজ হারাবেন। এর আগের দুটি সঙ্কটে শেয়ার বাজারে দর পড়ে গিয়েছিল ৫০শতাংশ, ক্রেডিট মার্কেট প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকহারে দেউলিয়া হতে শুরু করেছিল। বেকারত্ব দশ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল তিন বছর সময় ধরে। আর করোনাভাইরাসের বিশ্ব মহামারি শুরু হওয়ার পর এবারের অর্থনৈতিক ধসটা ঘটেছে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির কী দশা হবে, তার ভয়ংকর সব পূর্বাভাস এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি। আইএমএফ এর মতে, এবছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে তিন শতাংশ। যদি মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।
করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম একটা নীতি হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। সকল ধরনের সামাজিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। বৃহত্তর স্তর বা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও এমনটাই দেখছি আমরা। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশগুলো এক অপরের সাথে প্রায় সব ধরনের শারীরিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে সকলেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক লেনদেন সীমিত হয়ে পড়ছে। যা বিশ্বায়ানের অন্তরায়। চ্যাথাম হাউসের নির্বাহী পরিচালক রবিন নিবলেটের ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত লেখায় তিনি বলেছেন,“বিশ্বায়ন বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তার পরিসমাপ্তি এখানেই। করোনাভাইরাস হচ্ছে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে ধরণের বিশ্বায়ন দেখা গেছে, যাতে উভয়পক্ষই সুবিধা পেয়েছে, বিশ্ব আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে তেমন সম্ভাবনা কম।”
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ও করণীয়
চলমান করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রভাবে সকল দেশের জনগণের জীবন একদিকে যেমন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে, একই সাথে প্রায় সকল রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থার চিন্তার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল রাষ্ট্রের সরকার কাজ করছে জনগণের জরুরি সেবা নিশ্চিতের জন্য। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি, ক্ষুধা নিবারণ এবং দারিদ্র্যের হার নিয়ন্ত্রণেই প্রায় সকল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আর এই অর্থের মূল যোগানদাতা হলো বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকসমূহ এবং দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র সচল রাখার জন্য। কিন্তু মহামারীর প্রভাবে রাষ্ট্রের আয়ের প্রায় সকল উৎস এখন বন্ধ হয়ে আছে। যদিও বাংলাদেশসহ বিশ্বে বেশ কয়টি দেশ সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে, কিন্তু তা একটি দেশের অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করতে যথেষ্ট নয়। বরং চলমান পরিস্থিতিতে দেশের দারিদ্র্যের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি পুরোদমে চালু না হলে বাংলাদেশের মতো দরিদ্রতম দেশগুলো অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতে পড়বে। কেননা, বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। ফলে রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়া কিংবা প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর টিকে না থাকার সম্ভাবনাও খুব প্রবল।
মহামারীর পথ ধরে আসে দুর্ভিক্ষ
মহামারীর হাত ধরে আসবে অর্থনৈতিক ধস। আর অর্থনৈতিক ধস মানেই অরাজকতা ও দুর্ভিক্ষের হাতছানি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধস নামলে মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। রপ্তানি কমে যাবে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে সচল রাখার কারিগর অর্থাৎ বৈদেশিক রেমিটেন্স কমে যাবে। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে এবং পণ্যের চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
করোনা সংক্রমণের শুরুতেই জাতিসংঘ (ডাব্লিউএফপি) বিশ্ববাসীকে সতর্কতা জানিয়ে বলেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ব বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে। সংস্থার প্রধান ডেভিড বেসিল বলেন, কঠিন বাস্তবতা হলো, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর চাইতেও বেশি মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যেতে পারে।’ সংস্থাটি আরো জানায়, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৮২ কোটি ১০ লাখ মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। আর অন্তত তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের করণীয়
করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তা মোটেই টেকসই নয়। আজকের শহুরে মানুষেরা একমাস কর্মহীন থাকলেই বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন না, সন্তানদের শিক্ষা বা স্বাস্থ্যব্যয় বহন করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সেই তুলনায় গ্রামীণ সমাজ নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় একেবারেই কম, আধুনিক লাক্সারি সুবিধা না থাকলেও মাসের পর মাস তারা নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে। সামগ্রিক বিবেচনায় এখন বড় বড় শহরগুলো অসাড় হয়ে পড়েছে, ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারেই সারশূন্যহীন তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। সুতরাং করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রচলিত অর্থনীতিতে ধস নামলে একমাত্র কৃষিই আমাদেরকে বাঁচাতে পারে। সুতরাং, শুধু মুখের কথাই নয়, আগামী দিনের কথা চিন্তা করে কৃষিতে স্বাবলম্বী হওয়া, কৃষি সমস্যার সমাধান করাই হবে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা। যেহেতু আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং কৃষি জমির সংকট রয়েছে, সেহেতু প্রতি ইঞ্চি মাটিকে উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকলকে উদ্দেশ্য করে কৃষি জমিকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এতে সাড়া তেমনটা পাওয়া যাচ্ছে না। যা আমাদের জন্য ভয়ানক অবস্থা ডেকে আনতে পারে।
মানবতার কল্যাণকামী আন্দোলন হেযবুত তওহীদ ইতোমধ্যে আগামী দিনের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা ও প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরনের কৃষি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সামর্থ্য অনুসারে এ আন্দোলনের কর্মীগণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাধ্যানুসারে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তারা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা হলো অপ্রতুল কৃষি জমি ও পুঁজি সংকট। হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম ইতোমধ্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদেরকে জমি ও পুজিঁ দিন। আমরা শ্রম দিয়ে আগামী দিনের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদনের শ্রম দিতে প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের হাজার হাজার কর্মীরা এ দুযোর্গকালে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।’
এ বিষয়ে সরকারের আশু পদক্ষেপ কাম্য।