রিয়াদুল হাসান
কোভিড ১৯। নভেল করোনা ভাইরাস। এক অদৃশ্য জীবাণুর তাণ্ডবে পৃথিবী আজ বিধ্বস্ত। দিশেহারা মানবজাতি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় লাশের সংখ্যা গোনা ছাড়া আর কিছুই কি করার নেই। এ পর্যন্ত (৩১ জুলাই ২০২০) সমগ্র বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২১৫ টি দেশ ও অঞ্চলে ১,৭৪,৭৭,৪১৯ জন। মোট মৃতের সংখ্যা ৬,৭৬,৭৯৭ জন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। সরকারি হিসাবমতে মোট আক্রান্ত ২৩৪,৮৮৯ আর মৃতের সংখ্যা ৩,০৮৩ জন।
এই মুহূর্তে প্রত্যেক মানুষের মনে একটি মাত্র চিন্তা, কী হবে শেষ পর্যন্ত? সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে? লক ডাউনে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে গেছে। শ্রমিকের অভাবে মাঠেই নষ্ট হচ্ছে ফসল। লক্ষ লক্ষ মেট্রিকটন আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস নষ্ট হচ্ছে পরিবহনের অভাবে। বাজারজাত করতে না পারায় নষ্ট হচ্ছে সারা দেশে উৎপাদিত ডিম, দুধ। ধ্বংস হচ্ছে কৃষি খামার। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। সরকারের দেওয়া ত্রাণ আর অনুদানের কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে আমলা আর নেতাদের ভোগে। তাদের উচ্ছিষ্টও জুটছে না গরীব মানুষের কপালে।
জাতির ভাগ্যাকাশে আবারও দুর্যোগের ঘনঘটা। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ভয়াবহ খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। জাতিসংঘ বলছে, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব বড় রকমের দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। দুর্ভিক্ষের বিপর্যয় ঠেকাতে অর্থ সাহায্য চেয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে ক্ষুধাময়। বাইবেলে বর্ণিত ভয়াবহ সেই ‘দুর্ভিক্ষ’ আবার দেখবে পৃথিবী। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ডবিøউ এফ পি বলেছে, এই মন্দায় ১৩৫ থেকে ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ভুগবে। মারা যেতে পারে তিন কোটি মানুষ। আইএমএফের পূর্বাভাস: ১৯৩০ সালের মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে ২০২০ সাল।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কী করণীয়? সেটাও তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনার প্রভাব মোকাবেলায় কৃষিই ভরসা (ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কালের কণ্ঠ অনলাইন, ২৩ এপ্রিল, ২০২০)। পতিত জমি ও ছাদে সবজি চাষ দূর হবে করোনায় খাদ্যসংকট (দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল ২০২০)। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলছেন, ‘এই দুঃসময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু সচল রাখা নয়, আরও জোরদার করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে যাতে কোনোপ্রকার খাদ্য সঙ্কট না হয়, সেজন্য আমাদের একখÐ জমিও ফেলে রাখা চলবে না। (বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর.কম ১৩ এপ্রিল ২০২০)।
এমন একটি দুর্যোগ যে ঘনিয়ে আসছে সে সতর্কবার্তা কয়েকবছর থেকেই দিয়ে আসছিলেন হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। বহু জনসভা, সেমিনার, আলোচনা সভায় তিনি আসন্ন বিপর্যয় ও তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। আজ থেকে তিন বছরেরও বেশি সময় পূর্বে ২৪ ফেব্রæয়ারী ২০১৭ তারিখে ঢাকার লালবাগের জনসভায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তিনি বলেন, “আল্লাহ মাটি দিয়েছেন, মাটি কর্ষণ করো। প্রতিটি ইঞ্চি মাটিকে, প্রতিটি ইঞ্চি জলমহলকে উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসো। তাহলে জাতি সমৃদ্ধ হবে, তুমিও সমৃদ্ধ হবা। তোমার রোজগারের মধ্যে জাতির একটা অংশ রয়েছে, অধিকার রয়েছে, হক রয়েছে। মানবতার কল্যাণে আমরা আমাদের উৎপাদিত, আমাদের আয়কৃত, আমাদের রোজগারকৃত অর্থের একটা অংশকে আমরা ব্যয় করি।”
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে তিনি বলেন, “প্রতি ইঞ্চি মাটিকে, প্রতিটি জলমহাল কে উৎপাদনের আওতায় আনতে হবে। মদিনার মত বাংলাকে রক্ষা করতে হবে। সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে আমরা একটা সমবায়ভিত্তিক প্রচেষ্টা করব। এই সমবায়ভিত্তিক সঞ্চিত অর্থগুলিকে বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিভিত্তিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা এটাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে উপকার হবে কয়েকটা, প্রথমত আমাদের ভাই বোনদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান হবে, তারা মাটিকে ব্যবহার করার সর্বোত্তম জ্ঞান লাভ করবেন। দ্বিতীয়ত, সংকটকালীন সময়ে তারা সঙ্কট অতিক্রম করতে পারবে। তারা অন্ততঃ সারভাইভ করতে পারবে, অন্তত বেঁচে থাকতে পারবে।
ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী, এখানে পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়। এখানে বুড়িগঙ্গা যান, পাশের বালু নদীতে যান, মাইলকে মাইল আপনার মুখ ঢেকে রাখতে হবে। পানি দূষিত, বায়ু দূষিত, এমন এমন জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে, চিন্তা করতে পারবেন না। গবেষকরা বলেছেন, গত কয়েক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ টি নতুন রোগ সৃষ্টি হয়েছে যেটা মানুষ জানত না। পশুর রোগ, গরুর রোগ মানুষের শরীরে বিস্তৃত হচ্ছে, জটিল দুরারোগ্য ব্যাধি। এখন তো সরকার আইন করেছে, ২৩ রকমের রোগের যে কোন একটা হলে আপনাকে ওই যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে, না হলে কিন্তু আপনাকে জেলে যেতে হবে। কারণ সংক্রামক রোগগুলো একজনের হলে পরে অন্যদেরও হবে। সুতরাং স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি যে কোনো কারণই কিন্তু খুব ভয়াবহ!” [স্থান: জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, গেন্ডারিয়ার, ঢাকা।]
অপর একটি আলোচনা সভায় তিনি এও বলেছিলেন, “সংকটে পড়লে নিজের কলিজাখানা বের করে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছা হবে। নিজের মাসুম বাচ্চা যখন বলবে, ‘বাবা খাবার দাও’ তুমি খাবে না, তুমি ডাকাতি করতে বাধ্য হবে। নিজের মাসুম বাচ্চা যখন বলবে, ‘বাবা ওষুধ দাও’, তুমি ডাকাতি করতে বাধ্য হবে। তোমার বাচ্চার ঐ চিৎকার তুমি সহ্য করতে পারবে না। তুমি নিজে না খেয়ে মরবে, তবু বাচ্চার মুখে খাবার দেওয়ার জন্য তুমি পাগলপারা হয়ে যাবে। তুমি আমার এই কথা লিখে রাখো। আমি এমনি এমনি বলি নাই, আমি সংকট দেখতে পাচ্ছি, সুনামি দেখতে পাচ্ছি। ইনশাল্লাহ যদি তোমরা আমার কথার উপর দণ্ডায়মান হতে পারো, একটা আদর্শের উপরে জাতিটাকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারো, দেখবে সমস্ত জাতি হেযবুত তওহীদকে অনুসরণ করবে। আমার এই কথা পাঁচশো টাকার স্ট্যা¤েপ লিখে রাখতে পারো।” [স্থান: উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব, ঢাকা; তারিখ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮]
হেযবুত তওহীদ একটি জীবনমুখী আন্দোলন। প্রচেষ্টাহীন দোয়া ও পরকালের জন্য সওয়াব সঞ্চয় হেযবুত তওহীদের শিক্ষা নয়। বাস্তব সংকটের বাস্তব সমাধানই হচ্ছে এর আদর্শের মূল অভিপ্রায়। তাইতো জাতির নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার হেযবুত তওহীদ কর্মী তাদের পেশা ও জীবনকে পরিবর্তন করে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে নেমে পড়েছেন মাঠে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা হেযবুত তওহীদের সদস্যদের যার যতটুকু জমি আছে সেগুলোকে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। বাড়ির আঙিনায়, বাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকা জমিটুকুও তারা আর অনাবাদি ফেলে রাখছেন না। যাদের জমি নেই তারা অনেকেই বাড়ির ছাদে ছাদকৃষির উদ্যোগ নিয়েছেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কৃষিকাজে তাদের মাথার ঘাম পায়ে ঝরাচ্ছেন। কেবল জমিতেই নয়, মাছ চাষেরও ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে হেযবুত তওহীদ। মজা পুকুর ও অব্যবহৃত দিঘিকে মাছ চাষের উপযোগী করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সফলতার মুখ দেখেছে বহু মৎস্য প্রকল্প। মাছের জৈব খাদ্যের যোগানের পাশাপাশি মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে নেওয়া হয়েছে সমন্বিত হাঁস ও মৎস্য চাষ প্রকল্প।
গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার যেখানে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে গুরুকে স্বাস্থ্যবান করে তোলা হচ্ছে। এখানে গরুর দেহে স্টেরয়েড বা অন্য কোনো প্রকার রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় না। কৃষিবিজ্ঞানের সূত্র মেনে তৈরি সুষম খাদ্যে পরিপুষ্ট গরুর জন্য ইতোমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে হেযবুত তওহীদের গরুর খামার। গরুর বর্জকে কাজে লাগিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে জ্বালানি গ্যাস যা রান্নার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে যেন কারো মুখাপেক্ষী না হতে হয়, দান ও দয়া ভিক্ষা না করতে হয়, তারা যেন নিজেদের অন্নসংস্থান করতে পারেন এবং অন্যদেরও কর্মসংস্থান করে দিতে পারেন এজন্য আরো কিছু ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন হেযবুত তওহীদের এমাম। গার্মেন্টস, ফুড এন্ড বেভারেজ ফ্যাক্টরি, কারখানায় প্রস্তুত পোশাকের শো-রুম, স্কুল, কোচিং সেন্টার, জুতা তৈরির কারখানা, চুল কাটার সেলুন, মনোহারি দোকান, চিকিৎসালয়, লন্ড্রি, পরিবহন, খাবার হোটেল, ফার্নিচারের দোকান, ওয়েল্ডিং এর দোকান ইত্যাদি বহুবিধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান লাভ করেছেন বহু সদস্য-সদস্যা।
মানবজাতিকে যে কোনো সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য নিজেদের জীবন ও সম্পদকে কোরবান করার প্রেরণা হেযবুত তওহীদের রক্তধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। সেই শিক্ষার ধারাবাহিকতা শিরায় উপশিরায় বহন করে চলেছেন তাঁরই আদর্শের উত্তরসূরি হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তাঁর দুর্বার নেতৃত্বে হেযবুত তওহীদের প্রত্যেক সদস্যের রক্তকণিকায় জাতিকে রক্ষা করার অদম্য স্পৃহা জাগ্রত হয়েছে। হেযবুত তওহীদের সদস্যরা তাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই মাঠে নেমেছ, মাঠে আছে। আমরা জাতির সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, যেন গোটা জাতি আসন্ন দুর্যোগের কাছে হার মেনে নেওয়ার আগে নিজেদের সবটুকু মেধা, শ্রম, যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে টিকে থাকার লড়াইতে অবতীর্ণ হতে অনুপ্রাণিত হয়।
[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ; ফোন: ০১৬৭০১৭১৬৪৩, ০১৭১১-০০৫০২৫, ০১৭১১-৫৭১৫৮১]