একটি সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের মানদ- যখন হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি তখন অবধারিতভাবে গোটা সমাজটা অশান্তিতে ডুবে যায়। আজকে আমাদের সমাজের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে এখানে নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা, আদর্শ বা মূল্যবোধের বিন্দুমাত্র মূল্যও নেই। এখানে ক্ষমতাধরের অন্যায়কে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। এখানে প্রতিটি মানুষ বেড়ে উঠে নিজ স্বার্থ উদ্ধারের দীক্ষা নিয়ে। সেই স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে সে সকল অন্যায়ের সাথে আপোষ করে নেয়। কখনো কারো কোনো অন্যায় নিজের স্বার্থের অনুকূলে গেলে সেই অন্যায়কে স্বাগত জানায়। আর তা স্বার্থের বিপরীতে গেলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু অন্যায়কারী যদি নিজের চেয়ে ক্ষমতাধর হয় কিংবা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে যদি স্বার্থহানির ঝুঁকি থাকে তাহলে সব নীরবে হজম করে নেয়। অন্যায়কারী যে-ই হোক, নিজের স্বার্থের অনুকূলে হোক আর প্রতিকূলে হোক, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজটাকে কলুষমুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করে যাবে, এমন মানুষ কোথায়? এই শিক্ষাই বা এখানে কে কাকে দেয়?
অন্যায়ের সাথে এই যে আপোষকামিতা, এই যে সমাজের প্রতি দায়িত্ব থেকে আত্মপলায়ন করে নিজেকে নিরাপদ রাখা, এ দিয়ে শেষ পর্যন্ত কি আমরা নিজেকে রক্ষা করতে পারি। পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে দেখে আমি যদি চুপ করে বসে থাকি তাহলে সেই আগুন কি আমার ঘর পর্যন্ত পৌঁছুবে না? অবশ্যই। ঠিক তেমনি পাশের গ্রামের একটা মেয়ে যদি ধর্ষিত হয়ে থাকে, আর অপরাধীরা নির্বিঘেœ পাড় পেয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে শীঘ্রই আমার গ্রামের দশটা মেয়ে ধর্ষিত হতে যাচ্ছে। আর তাদের মধ্যে আমার ঘরের মেয়েটাও একজন হতে পারে।
আজকে এমন একটা সিস্টেম আমরা নিজেদের জীবনে ও সমাজে কায়েম করে রেখেছি যে সিস্টেমটি হয় অন্যায়কারীদের ক্ষমতায় বসায়, নয়তো ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অন্যায় করতে বাধ্য কিংবা প্রলুব্ধ করে। এর ফলে সমাজে অন্যায়, অবিচার, জুলুম, দুঃশাসন যা কিছু ঘটছে সেগুলোকে প্রতিহত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো অবস্থা আপাতঃ দৃষ্টিতে কারো নেই। এমন জটিল দুরবস্থা থেকে নিজেকে, নিজের পরিবার ও সমাজকে, নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শর্তহীন জাতিগত ঐক্য ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই।
ন্যায়ের পথে ঐক্যের এতো গুরুত্ব কেন- তা আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। একথা হয়তো সকলেই অকপটে স্বীকার করে নেবেন যে, ঐক্যহীন বিচ্ছিন্ন সহ¯্র ব্যক্তির প্রচেষ্টার চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাভাবিক প্রচেষ্টাও অনেক বেশি কার্যকরী। যুগে যুগে সমাজে ভালো মানুষের জন্ম হয়েছে। কেউই অসৎ, মিথ্যাচারী, জুলুমকারী কিংবা অন্যায়কারী হয়ে জন্মায় না। কিন্তু একজন মানুষ জন্মের পর যে সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় তথা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশই তার চরিত্র গঠন করে দেয়। একটি সোজা পথ দিয়ে যেমনি বাঁকা চলা সম্ভব নয় তেমনি একটি বাঁকা পথেও কারো পক্ষে সোজা চলা অসম্ভব। সুতরাং আমাদের জীবন ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থাই আমাদেরকে ন্যায়-অন্যায়, সততা-অসততা ইত্যাদির শিক্ষা দেয়। তাই আমাদের উচিত ন্যায়ের পথে আগে নিজেদেরকে দ-ায়মান করা, অতঃপর সেই পথে জাতির প্রত্যেকটি নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করা। সর্বপ্রকার অন্যায়-অশান্তির বিরুদ্ধে এবং ন্যায়, শান্তি ও মানবতার কল্যাণের পথে এই জাতিগত ঐক্য নির্মাণের এখনই সময়।