ফেসবুকে আহসান সাদিক আকাশ নামে একজন প্রশ্ন করে- আজ কয়েকদিন বিভিন্ন ইসলামিক পেজে কিছু পোস্ট দেখলাম। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া নাকি পূজা করা বা শিরক করা। এ বিষয়ে জানতে চাই। এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে তাই উত্তরটা পত্রিকার পাঠকদের সাথেও শেয়ার করলাম।
আমার উত্তর:- ইসলাম সহজ-সরল দীন (সিরাতাল মুস্তাকিম)। কোনটা করলে সওয়াব আর কোনটা করলে গোনাহ এর সহজ ফায়সালা হলো- যা মানুষ ও জগতের জন্য কল্যাণকর তাই সওয়াব আর যা অকল্যাণকর তাই গোনাহ। যা কিছু অর্থবহ, যৌক্তিক ও সমাজের জন্য কল্যাণকর তা ইসলাম উৎসাহিত করে আর অনর্থক, অযৌক্তিক ও অকল্যাণকর কাজকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে। জায়েজ-নাজায়েজের এটাই সহজ মানদ-।
এখন প্রশ্ন হলো একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদমিনারে ফুল দেওয়া কতটুকু অর্থপূর্ণ কাজ বা এতে সমাজের কতটুকু কল্যাণ হয়। যারা ভাষার জন্য নিঃস্বার্থভাবে জীবন দিয়েছেন তাদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও দোয়া করা আমি বাংলাভাষী হিসাবে নিজের কর্তব্য মনে করি। কিন্তু সেই সম্মান, শ্রদ্ধা জানানোর প্রক্রিয়াটি যেন অর্থবহ হয় সে ব্যাপারে ভাবনার আছে। যারা সেদিন জীবন দিয়েছেন তাদের কবরস্থানটি সনাক্ত করে সেখানে গিয়ে কবর জিয়ারত করে সরাসরি কবরে ফুল দিয়ে তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা যেতে পারে, এতে তার পারলৌকিক কল্যাণ হতে পারে। তার উত্তর প্রজন্ম যারা বেঁচে আছেন তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে (যদি তারা দরিদ্র হয়ে থাকে) পার্থিব কল্যাণ করা যেতে পারে। তাদের জীবনের গল্পগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে বর্তমান প্রজন্মকে এমন নিঃস্বার্থ কাজে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। তাদের নামে কিছু অসহায়, দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করা যেতে পারে। এই দিনকে উপলক্ষ করে সমাজকল্যাণমূলক নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে এবং সর্বশেষ তারা যে কারণে জীবন দিলেন সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করবার কার্যকরী নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে অর্থাৎ বাংলা ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জীবন দিয়েছেন সুতরাং বাংলা ভাষা আজ যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, যেভাবে এই ভাষার সম্মান হানী করা হচ্ছে তা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এবং এই ভাষাকে বিশ্বের দরবারে কীভাবে উচ্চতম স্থানে নেওয়া যায় সে প্রচেষ্টা করা যেতে পারে।
এবার আসি পূজা বা শিরকের সাথে শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার সামঞ্জস্য সম্পর্কে:
শিরক অর্থ অংশিদার করা। অর্থাৎ কোনো শক্তিকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা বা আল্লাহ, প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, লালনকর্তা, ইলাহ (হুকুমদাতা) ইত্যাদি গণ্য করা।
মূর্তিপূজাকে শেরক গণ্য করা হয় এজন্য যে, পূজা করার সময় মনে করা হয় যে- এর (অর্থাৎ যার প্রতিমূতির সামনে পূজা করা হচ্ছে) সৃষ্টি করা, লালন-পালন করা, হুকুম করা, উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা আছে কিন্তু সর্বময় ক্ষমতা তো কেবল আল্লাহর। তাই মূর্তিপূজাকে শেরক গণ্য করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো- শহীদমিনারে গিয়ে যখন ফুল দেওয়া হয় তখন কি শহীদদেরকে বা শহীদমিনারকে আল্লাহর সমকক্ষ গণ্য করা হয়, অথবা এমন বিশ্বাস কি করা হয় যে, শহীদমিনারে ফুল দিলে তার বিদ্যা বেড়ে যাবে, তার রোগ সেরে যাবে? আমার জানামতে এই বিশ্বাস কেউই পোষণ করেন না যে, শহীদমিনারের কোনো কল্যাণ-অকল্যাণ করবার ক্ষমতা আছে। সুতরাং এটাকে শিরক বলাটা আমি যৌক্তিক মনে করি না। এই চেতনাকে লালনকারী জনগোষ্ঠী একটা নির্দিষ্ট স্থানে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য মনুমেন্ট তৈরি করলে সেটা যদি প্রভুর আসনে না বসানো হয় তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে সেটাকে শিরক, কুফর বলা যায় না।
সবচেয়ে বড় শিরক কোনটি?
যখন কোনো মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে তখন তাকে সাক্ষ্য দিতে হয়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (কলেমা)। অর্থাৎ আাল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে ও মোহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহর রসুল হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়া। যদি কেউ আল্লাহর হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করে তবে তা হবে সবচেয়ে বড় শেরক। বর্তমান মানবজাতি হুকুমদাতা হিসাবে মানছে কার? সুদভিত্তিক অর্থনীতি কার হুকুমে চলছে, জাতীয় পর্যায়ে সকল আইন-বিধান মান্য করা হচ্ছে পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরটা আর ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে আল্লাহকে উপাসনা করা হচ্ছে (যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি)। এটি সবচেয়ে বড় শিরক ও আল্লাহর সাথে প্রতারণার শামীল। আল্লাহ এই প্রতারকদের সম্পর্কে বলেছেন- ‘’তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ মান্য করো ও কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করো? অতএব তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের পার্থিব জীবনে দুর্গতি ব্যাতীত কিছুই নেই এবং কেয়ামত দিবসে তারা কঠোর শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে।’’ [সুরা বাকারা-৮৫]