দেশের মানচিত্রে শকুনের থাবা পড়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে সুযোগ নিচ্ছে শকুনীরা। এদের রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন হেযবুত তওহীদের সর্বোচ্চ নেতা এবং সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সোসাইটির চেয়ারম্যান এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম।
গতকাল শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকাল তিন টায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের রয়েল প্যালেসের হল রুমে হেযবুত তওহীদের আয়োজনে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মব্যবসা ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে এ আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যারা সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় মত্ত, তারা বাংলাদেশের মানচিত্র খাবলে খাওয়ার জন্য শকুনের মত থাবা বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে একটি মহান আদর্শের ভিত্তিতে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
হেযবুত তওহীদের নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি মো. আরিফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. খোকন সাহা। বিশেষ আলোচক ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিএম আরমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন হেযবুত তওহীদের তথ্য ও গণমাধ্যম বিভাগের সম্পাদক এসএম সামসুল হুদা, হেযবুত তওহীদের ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ, হেযবুত তওহীদের সিলেট বিভাগীয় সভাপতি মো. আলী হোসেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর তাঁতীলীগের অহ্বায়ক চৌধুরী এইচএম ফারুক সাহেদ, সিদ্ধিরগঞ্জ ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মো. মহসীন ভূইয়া, নারায়ণগঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সস্পাদক কাজী মো. ওয়াসিম।
শহরের বিভিন্ন উপজেলা এবং আশপাশের জেলা থেকে শত শত নেতাকর্মী বিকাল ৩টার মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জের রয়েল প্যালেস চৌধুরী বাড়ি হলরুমে উপস্থিত হলে অনুষ্ঠানস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শত শত নেতাকর্মীর মুহুর্মুহু করতালি এবং শ্লোগানের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক হেযবুত তওহীদের এমাম যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়।
প্রধান আলোচক হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ভূখণ্ড আমরা লাভ করেছি। এই ভূখণ্ডের মানুষ ঐতিহাসিক কাল থেকে দল-মত নির্বিশেষে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছিল। এখানকার মাটি যেমন উর্বর, আবহাওয়া যেমন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা, তেমনি মানুষগুলোর চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হলো সরলতা, পরিশ্রম, সহযোগিতা, সহমর্মিতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না যে, বাঙালি জাতি কখনো অন্য কোনো জাতির উপরে জুলুম করেছে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। বরং যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি এবং ধর্মের লোকেরা এই বদ্বীপ অঞ্চলকে দখল করার জন্য হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যাইহোক ৭১’ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছে, তখন আবারো শুরু হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো টানাটানি। তাদেরকে বারবার সুযোগ দেওয়া হয়। তাই আমরা একদিক থেকে তাদেরকে দোষ দিতে পারি না। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, স্বার্থের রাজনীতি, ধাপ্পাবাজির রাজনীতি, আদর্শহীন রাজনীতি, এই রাজনৈতিক হানাহানের সুযোগটাই তারা নিয়েছে।
তিনি বলেন, এখন সময় হয়েছে এই ব্যর্থ ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার। প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতির মধ্যে চরম এক অনিশ্চয়তার অবস্থা সৃষ্টি হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয় সহিংসতা, অবরোধ, হরতাল, বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা। একটি জাতির মধ্যে এই ধরনের অবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধান করার সময় এসেছে। এসময় তিনি একটি আদর্শ প্রস্তাব করেন, যে আদর্শ আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আল্লাহর রসুল (সা.) নিয়ে এসেছিলেন।
এরপর তিনি ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজে গোত্রে গোত্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সুদ, চুরি-ডাকাতি, নারী-নির্যাতন, দাসপ্রথা, কুসংস্কার, হুজুগ-গুজব, অশ্লীলতা, মাদক, জুয়াসহ যাবতীয় অন্যায় চরম আকার ধারণ করেছিল। এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ মহানবীকে (সা.) মানুষের দুর্দশা দূর করার উপায় ও পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করলেন। সেটি হচ্ছে ইসলাম। অর্থাৎ মানবজাতিকে আল্লাহর তৈরি জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’ মেনে চলতে হবে। এজন্য প্রথমে তাদেরকে এই জীবনব্যবস্থার মূলমন্ত্র তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই তওহীদের অঙ্গীকার হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.), অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম-বিধান ছাড়া আর কারো হুকুম মানি না এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রসুল। তওহীদের আহ্বান করার সাথে সাথেই আরবের গোত্রপতি ও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী জনগণকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখতে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াতে শুরু করল। তাদের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে নবগঠিত জাতিটি একদেহ একপ্রাণ হয়ে মানুষের মুক্তির জন্য আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, কোরবানি ও শাহাদাতের বিনিময়ে আরব উপদ্বীপে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হল।
রসুল (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন প্রতিষ্ঠার ফলে সমগ্র আরব উপদ্বীপে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জীবন-সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোনো মামলা আসত না। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা ঘুষ-দুর্নীতি থেকে ছিলেন মুক্ত। মানুষের অভাব দূর হয়ে গেল, মদ্যপান বন্ধ হল, মানুষ সুস্থচিন্তার অধিকারী হল। সালাত, যাকাত, হজ, সওম ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে মো’মেনদের ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, আত্মিক পরিশুদ্ধি, দানশীলতা, পবিত্রতা, তাকওয়া অর্জন ইত্যাদির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হল। নব্যুয়তের প্রথম ২৩ বছরে সমগ্র আরবে ও পরবর্তী ৬০/৭০ বছরে অর্ধ পৃথিবীতে এই অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল। মাত্র এক শতাব্দির ব্যবধানে পৃথিবীর সবচেয়ে অবজ্ঞাত, মূর্খ, অশিক্ষিত, বিশৃঙ্খল, ঐক্যহীন জনগোষ্ঠীটি শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, সামরিক শক্তিতে, ধন-সম্পদে, ঐক্যে, শৃঙ্খলায়, আত্মিক পবিত্রতায়, নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারে, ন্যায়ের শাসনে পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছিল। সে সময় উম্মতে মোহাম্মদীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর হিম্মত কারো ছিল না। দুইটি বিশ্বশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য নবগঠিত মুসলিম জাতির সামনে তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল। তাদের এই অভূতপূর্ব বিজয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছিল ইসলামের সোনালি যুগ প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি আফসোস করে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস হচ্ছে, আল্লাহর রসুল (সা.) ও তাঁর হাতে গড়া জাতিটির সকল সদস্য একে একে চলে যাওয়ার পর একটা পর্যায়ে জাতির আকিদায় বিকৃতি প্রবেশ করতে শুরু করল। সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে রসুলাল্লাহ (সা.) জাতিটি গঠন করেছিলেন, সাহাবিরাও সে লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করে অর্ধ-পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু তারপরে সে লক্ষ্য জাতির সামনে থেকে হারিয়ে গেল। তারা ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে পরাজিত হয়ে তাদের গোলাম হয়ে গেলে। এখন পশ্চিমারা আমাদের ব্যাপারে মাতব্বরি করে। তারা একে একে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান ধ্বংস করে দিল। এখন তাদের শকুনী দৃষ্টি পড়েছে আমার প্রিয় জন্মভূমির উপর। তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তাদের কূট চাল চালছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সংলাপ উল্লেখ করে এই বক্তা বলেন, বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। শকুনের হাতের থাবা। শকুন যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে কোনো সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। হেযবুত তওহীদ থাকতে তাদের এই দূরাশা কোনো দিন পূর্ণ হবে না ইনশাল্লাহ। প্রয়োজনে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য জীবন দেব তবুও দেশকে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান হতে দিব না।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. খোকন সাহা বলেন, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি অপশক্তির হস্তক্ষেপ বাংলার জনগণ মেনে নেবে না। যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত করতে হবে।
তিনি প্রধান আলোচক হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের বক্তব্যের সাথে সহমত প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশরে রক্ষার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা হেযবুত তওহীদের সাথে আমরা আছি। নারায়ণগঞ্জে কোনো প্রকার সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িকতা আমরা হতে দিব না। এ লক্ষ্যে হেযবুত তওহীদের সাথে একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশেষ আলোচকসহ অন্যান্য বক্তারাও প্রধান আলোচক ও প্রধান অতিথির বক্তব্যের সাথে সহমত প্রকাশ করেন। সবশেষে প্রশ্নত্তোর পর্বে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম।