ইলিয়াস আহমেদ:
মানুষ কতদিন বাঁচে? খুব বড়জোর একশো। যদিও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭০/৭২ বছর, প্রত্যেকেই আসলে ৭০ বছরও বাঁচেনা। মৃত্যু কখন দুয়ারে আসবে, আমরা কেউই জানি না। কুড়ি বছরের টগবগে তরুণ, ষোল বছরের চঞ্চলা কিশোরী, ৩ বছরের দুধধোয়া শিশু কেউ রেহাই পায়নি। এই নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মিথ্যে স্বপ্নে আমরা তবু আকৃষ্ট হই, বেঁচে থাকার জন্য এমন কিছু নেই যা করি না। কতদিন বেঁচে থাকব, তা না জেনেও অজস্র স্বপ্ন দেখি, আশায় বুক বাঁধি। মানুষ যদি জানত তার মৃত্যু কবে, তবে দুশ্চিন্তায় লিকলিকে, রোগাক্রান্ত, বিমর্ষ হয়ে বেঁচে থাকত ঐ কটা দিন। তার পৃথিবী থেকে আনন্দ-উল্লাস, রঙ্গিন স্বপ্ন সবই হারিয়ে যেত। পৃথিবীটা তখন মনে হত কোনো এক মৃত্যুপুরী। খাওয়া নিয়ে, সৃজনী চিন্তা নেই, জীবন নিয়ে ব্যস্ততা নেই, মানুষ শুধু তার ঐ নির্দিষ্ট দিনটার জন্য অপেক্ষা করত। চিন্তা করলেই গা শিউরে উঠে। এজন্যই বোধহয় সবকিছু সবাইকে জানতে হয় না, জানাতে হয় না।
যাইহোক, আমরা অনিশ্চিত জীবনের মাঝেও বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়েছি, এই তো বেশ! কিন্তু আমরা আসলে বাঁচার জন্য যে সুযোগ পেয়েছি, সেটিই বা কতটুকুন ব্যবহার করতে পারছি? আমাদের শৈশব কেটে যায় আমাদের অজ্ঞাতসারে, কৈশোর থেকে যৌবন কেটে যায় জীবনটা গুছিয়ে নিতে নিতে, আর প্রৌঢ়ত্ব কাটে সংসারের ঘানি টানতে টানতে। কখন যে বার্ধক্যের ঘুণ আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে টেরই পাই না। হঠাৎ করে আয়নায় দেখি, জীবনের সময় চলে গেছে। এতটুকুন জীবনকে বুঝতে না বুঝতেই শেষ! কী করলাম এক জীবনে, কিইবা পেলাম এ জীবনে আর শেষ গন্তব্য কোথায়? এসব সমীকরণ মেলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিজেকে তখন খুবই তুচ্ছ মনে হয়।
মানুষের এই জীবনের সাথে একটা চতুষ্পদ প্রাণীর জীবনের পার্থক্যটা আসলে কোথায়? একটা প্রাণী জীবনের যে স্তরগুলো যেভাবে একে একে পার করে শেষ জীবনে পৌঁছায় আমরাও তো সেভাবেই পৌঁছেছি। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়। আমাদের শিক্ষায়? আমরা বেশি বুদ্ধিমান? এই জ্ঞানার্জন, বুদ্ধির বিকাশ আসলে আমরা জীবনে বেঁচে থাকার জন্যই প্রয়োগ করেছি কিন্তু মানবজীবন সার্থকতা লাভের জন্য করিনি। আমরা যদি চতুষ্পদ প্রাণীর মত পৃথিবীটাতে বেঁচে থাকার জন্য আদিমতাকে বেছে নিতাম, তবুও বেঁচে থাকতাম। আমাদের শরীর-মন ঠিকই এই প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানিয়ে নিত। মানুষের ইতিহাসও তাই তাই বলে।
বেঁচে থাকার জন্য আমরা এমন এক জীবনব্যবস্থা (ঝুংঃবস ড়ভ খরভব) বেছে নিয়েছি যেটা আমাদের জীবনকে সহজ করেনি, বরং দিনকে দিন কঠিন করেছে। ভোগবাদের মাধ্যমে আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ বাড়িয়েছি। সেই উপকরণ অর্জনের জন্য সময় কমিয়েছি, জীবনকে করেছি আরও ব্যস্ততাময়। সবই করেছি নিজেদের জন্য, নিজের জন্য, নিজের বেঁচে থাকার জন্য।
অসীম লক্ষ্যমাত্রার চাহিদা পূরণ করতে করতে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছে দেখি আমার দীর্ঘ জীবনের চেয়ে গাছের মগডালে দোল খাওয়া স্বল্পায়ু পাখিদের জীবনই সুখের, উপভোগের।
তবে কি মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াটাই অপরাধ, ব্যর্থতার? না। মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কেবলমাত্র বেঁচে থাকা নয়। মানুষের এই জ্ঞানার্জন, বুদ্ধিবিকাশ কেবলমাত্র বেঁচে থাকার লক্ষ্যে নয়। মানুষের জীবন আর চতুষ্পদ প্রাণীর জীবন এক নয়। মানুষকে মহান স্রষ্টা অনেক উঁচুমানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। মানুষের বেঁচে থাকা হল উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য নয়। মানুষ বেঁচেই থাকবে সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। যার এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই, তার বেঁচে থাকা আর একটা চতুষ্পদ প্রাণীর বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা আসলে কি? আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগত যেভাবে সত্য-সাম্য-ন্যায় দিয়ে পরিচালনা করছেন, সেভাবে আমাদের পার্থিব জীবনে পরিচালনা করা। তিনি যেভাবে আমাদের সামগ্রিক জীবনে চলতে বলেছেন সেভাবেই চলা। কিন্তু বাস্তব হল আমরা তাঁর হুকুম-নির্দেশ আমাদের নিজেদের মত কাস্টমাইজ করে চলছি। আল্লাহর জীবনব্যবস্থার পরিবর্তে নিজেদের জীবনব্যবস্থা নিজেরাই বানিয়ে চলছি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। উপরে বলে এসেছি সে কথা। আমরা জীবনকে করেছি কঠিন। দেহ ও আত্মার ভারসাম্য হারিয়েছি। মানসিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে চরিত্রের সুন্দর গুণগুলো খারাপ গুণ দ্বারা পরিবর্তন করেছি।
মানবিকসত্তাকে কলুষিত, নোংরা করে ধর্মের সুবাসিত আবরণে লুকনোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছি। সেই নোংরামি-আবিলতার ছাপ আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্র। এখানে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নৈতিকতার স্থান নেই। নৈতিকতা থাকে কাগজে-কলমে, বক্তৃতায় আর তার পদস্খলনই যেন আইন-নীতির প্রয়োগ, সিদ্ধ-নিষ্পন্ন। কারণ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ (চৎরড়ৎরঃু) যখন বেঁচে থাকা, তখন বাকি সব নগণ্য।
মানুষ যতক্ষণ নিজের তৈরি জীবনব্যবস্থায় (ঝুংঃবস ড়ভ খরভব) থাকবে, মানুষ যত চেষ্টাই করুক, জ্ঞান-বুদ্ধির সর্বোচ্চ মাত্রার প্রয়োগ করেও সুখী হতে পারবেনা, সফল হতে পারবে না। মানুষ স্রেফ রক্তমাংসে গড়া কোনো প্রাণীই নয়, তার ভিতরে আত্মিক একটা সত্তা আছে, যেটা তাকে অন্য সৃষ্টি থেকে পৃথক করেছে, অনন্য করেছে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে একমাত্র স্রষ্টার দেয়া জীবনব্যবস্থাই মানুষকে সার্থক-সফল করতে পারে, আর অন্যকিছু নয়।
[লেখক: প্রযুক্তিবিদ ও প্রাবন্ধিক। যোগাযোগ: ০৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১]