রিয়াদুল হাসান:
আল্লাহ মুসলিম জাতিকে মানবজাতির মধ্যে সর্বোত্তম জাতি হিসাবে ঘোষণা করেছেন কারণ তিনি এই জাতির উত্থান ঘটিয়েছেন এই জন্য যে, তারা মানবজাতিকে ন্যায়ের নির্দেশ দেবে ও অন্যায় প্রতিহত করবে (সুরা এমরান ১১০)। স্বভাবতই, জাতি যদি এই কাজ জাতিগতভাবে ত্যাগ করে তবে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না, তারা নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হবে। বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে মুসলিম উম্মাহর পথ প্রদর্শক বা রাহবার দাবি করেন, তারাই যখন এক্যহীন, পরস্পর বিবাদে লিপ্ত, মাসলা মাসায়েল নিয়ে কূটতর্কে জড়িত থাকেন তখন সেই জাতির পক্ষে শ্রেষ্ঠত্বের আসন ধরে রাখার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। যেমন: যখন জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি ও ব্যাংকিং পদ্ধতি হিসাবে সুদকে প্রচলন করা হয় তখন আমরা দেখি একদল ইসলাম বিশেষজ্ঞ সেটাকে হারাম বলে ফতোয়া দেন, এর বিরুদ্ধে ওয়াজ করেন, আরেকদল সেটাকে জায়েজ করার জন্য বহু রকম ব্যাখ্যা বের করেন, বিভিন্ন হেকমত বের করে, ইজমা, কেয়াস করে বহু রকম নাম দিয়ে সেটিকে জায়েজ করেন। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উপর্যুপরি মিথ্যাচার ও পরস্পর বিপরীতমুখী ফতোয়া প্রদানের ফলে সাধারণের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, ইসলাম বোঝা তাদের কম্ম নয়, ইসলাম নিয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই। ইসলাম বুঝতে হলে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে আগে ‘আলেম’ হতে হবে, নয়তো সেই স্বঘোষিত ওলামাদের কাছে যেতে হবে। এখন মাদ্রাসায় না পড়া কোন ব্যক্তি যদি ইসলামের প্রকৃত আকীদা বুঝতে পারেন, আল্লাহর সর্বব্যাপী তওহীদ উপলব্ধি করে তার ভিত্তিতে শতধাবিচ্ছিন্ন এই জনসংখ্যাটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্রতী হন, তখন কিন্তু এই আলেম দাবিদাররাই ফতোয়া জারি করে সাধারণ মানুষকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন এই বলে যে, ও ইসলামের কি বোঝে, ও কি মাদ্রাসায় পড়েছে, ওর কি দাড়ি আছে, সুন্নতি লেবাস আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাস, সেই সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি অবাঞ্ছিত, এমন কি কাফের সাব্যস্ত হয়ে যান, তাকে মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়, তার কোন কথাই শোনা হয় না। আজকের ধর্মের সেই ধারক বাহক মাওলানা, মুফতি, মোহাদ্দেস, মোফাস্সের যারা ওয়াজ করেন, ইমামতি করেন, যারা নিজেদের নায়েবে নবী বলে দাবী করেন, তাদের কাছে সবিনয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই।
১. আল্লাহ বলেছেন, “যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক শাসন করে না তারা কাফের, যালেম, ফাসেক”(সুরা- মায়েদা, ৪৪, ৪৫, ৪৭)। মুসলিম দাবিদার এই জাতি যারা তাদের জাতীয় জীবনে আল্লাহর বিধান অর্থাৎ কোর’আনের আইন মানে না, ইহুদি খ্রিস্টানদের তৈরি আইন কানুন মেনে চলে তারা এই আয়াত মোতাবেক মো’মেন বা মুসলিম থাকে কিনা?
২. রসুলাল্লাহ (সা.) যে সংগ্রাম করে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর সাহাবীরা দুনিয়ার সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে রসুলের উপর নাজেল হওয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করে উম্মতে মোহাম্মদী হয়েছিলেন, ঐ কাজ বাদ দিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী হওয়া সম্ভব কিনা?
৩. আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর (সুরা এমরান ১০৩)। রসুলাল্লাহ বলেছেন। তোমরা মতভেদ করো না, মতভেদ কুফর (হাদিস-আব্দাল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে- মুসলিম, মেশকাত)। আজ আটলান্টিকের তীর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অর্ধ পৃথিবীতে মুসলমান নামক এই জাতি ধর্মীয় মতবাদে শিয়া, সুন্নী, শাফি, হানাফী, আহলে হাদিস, আহলে সুন্নাহ ইত্যাদি, আধ্যাত্মিকভাবে নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, কাদেরিয়া, চিশতিয়া ইত্যাদি বহু তরিকায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ৫০টির বেশি ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে আছে। ইহুদি খ্রিষ্টানদের নকল করে তাদের রাজনৈতিক মতবাদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি হাজারো মতবাদে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগের পক্ষেও আলেমদের অবস্থান রয়েছে। আমার প্রশ্ন: মুসলিম জাতির মধ্যে এই যে বিভক্তি- এটা কুফর কিনা? উম্মাহর সংজ্ঞা মোতাবেক এই জাতি এত বিভক্তির পরেও এক উম্মাহ থাকে কিনা যেখানে আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘আমার উম্মাহ একটি দেহের ন্যায়’? [নুমান আল বশির (রা.) থেকে মুসলিম]
৪. আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন। “নিশ্চয়ই আল্লাহ যে কেতাব নাজিল করেছেন, যারা তা গোপন রাখে ও বিনিময়ে তুুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা নিজের পেটে আগুন ব্যতীত অন্য কিছুই পুরে না। [সুরা বাকারা-১৭৪]” যারা নামায পড়িয়ে, দোয়া করে, ওয়াজ করে আরও বহুভাবে ধর্মের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করেন, তারা আগুন খাচ্ছেন কিনা? যারা আগুন ভক্ষণ করেন, ধর্মের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন তারা কি মুসলিম থাকেন কি না?
৫. আল্লাহ মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘মো’মেন শুধুমাত্র তারাই যারা আল্লাহ এবং রসুলের উপর ঈমান আনার পর তাতে আর সন্দেহ পোষণ করে না অর্থাৎ দৃঢ় থাকে, এবং আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করে জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ (সুরা হুজরাত ১৫)।’ এই আয়াতের আলোকে এই জনসংখ্যাটি মো’মেন কিনা?
৬. আল্লাহ ওয়াদা করেছেন- তোমরা যদি মো’মেন হও তবে পৃথিবীর কর্তৃত্ব তোমাদের হাতে দেব যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দিয়েছিলাম (সুরা নুর ৫৫)। তাঁর ওয়াদা যে সত্যতার প্রমাণ নিরক্ষর, চরম দরিদ্র, সংখ্যায় মাত্র পাঁচ লাখের উম্মতে মোহাম্মদীর হাতে তিনি বিশ্বের কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহর ওয়াদা মোতাবেক এই জাতির হাতে আজ পৃথিবীর কর্তৃত্ব নেই কেন? কর্তৃত্ব দূরে থাক, এ জাতি আজ ফুটবলের মত অন্যান্য সব জাতির লাথি খাচ্ছে। তাহোলে এই জাতি যদি নিজেদের মো’মেন বা ঈমানদার দাবি করে তবে তাদেরকে বলতে হবে যে, আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। আর আল্লাহ যদি মিথ্যা না বলে থাকেন তবে এই জাতি তার সমস্ত নামায, যাকাত, হজ্ব রোযা সব সুদ্ধ বেঈমান অর্থাৎ কাফের, মোশরেক। আর কোন সিদ্ধান্ত আছে কি?
৭. আল্লাহ মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি (আল ইমরান ১১০)। আজ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বনিকৃষ্ট হওয়ার পরও, সকল জাতির মার খেয়েও, সকল জাতির গোলামি করার পরও মুসলিম দাবিদার জাতিটি সর্বশ্রেষ্ঠ? নাকি এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে মুসলিম নয়?
৮. আল্লাহ বলেছেন - তিনি মো’মেনদের ওয়ালী (সুরা বাকারা ২৫৭)। ওয়ালী অর্থ- অভিভাবক, বন্ধু, রক্ষক ইত্যাদি। আল্লাহ যাদের ওয়ালী তারা কোনদিন শত্রুর কাছে পরাজিত হতে পারে? তারা কোনদিন পৃথিবীর সর্বত্র অন্য সমস্ত জাতির কাছে লান্ছিত, অপমানিত হতে পারে? তাদের মা-বোনরা শত্রুদের দ্বারা ধর্ষিতা হতে পারে? আল্লাহ কি এই জাতিকে রক্ষা করতে অসমর্থ? (নাউযুবিল্লাহ)
৯. রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন। আমি সেগুলি করার জন্য তোমাদেরকে আদেশ করছি। সেগুলো হলো:
ঐক্যবদ্ধ হও।
(নেতার আদেশ) শোন।
(নেতার ঐ আদেশ) পালন করো।
হিজরত করো।
(এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো।
যে ব্যক্তি (কর্মসূচির) এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পোড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারি (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল ইমারাত, মেশকাত]।
এই হাদিস মোতাবেক জাতিটি ঐক্যবদ্ধ না হয়ে, নেতার আদেশ না শুনে, পালন না করে, হিজরত না করে এবং জেহাদ না করে নিজেদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে ফেলেছে কি না এবং জাহান্নামের জ্বালানি পাথর কি না?
আমি জানি, কেতাবি জ্ঞানের তীব্র অহংবোধের কারণেই হোক আর ধর্মব্যবসায় ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই হোক, এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার সৎসাহস অধিকাংশ ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যক্তিরই হবে না। তবু প্রশ্নগুলি রাখলাম কারণ এগুলি থেকে হয়তো কোন সত্যান্বেষী মন এগুলির সঠিক উত্তর খুঁজে নেবেন।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৭৫১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৫১