ক্রীড়া প্রতিবেদক:
পাকিস্তান ক্রিকেটে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে দলে এসে উত্থানের জন্ম দেওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এশিয়া কাপে শাহিন শাহ আফ্রিদি ইনজুরির কারণে দল থেকে ছিটকে গেলে দলে সুযোগ পান নাসিম শাহ। এরপর বলতে গেলে নতুন এক বোলিং সেনসেশনেই পরিণত হন তিনি। সেই নাসিম শাহের অসুস্থতায় আবার দলে সুযোগ মিলে যায় তরুণ অলরাউন্ডার আমের জামালের। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে অভিষিক্ত জামালের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে দুর্দান্ত জয় পায় পাকিস্তান।
টি-টোয়েন্টির পর আমের জামালের টেস্ট অভিষেকটা হলো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চলমান সিরিজে। পার্থে অভিষেক টেস্টেই করলেন বাজিমাত। অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমে ক্ষুরধার বোলিংয়ে প্রথম ইনিংসে ১১১ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ফিরিয়ে আনেন ৫৯ বছর আগের স্মৃতি। তার আগে টেস্ট অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি ছিল পাকিস্তানের আর কেবল একজনের। এ ছাড়া সব দেশ মিলিয়ে সফরকারী বোলার হিসেবে অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৬ উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে আর কেবল একজন বোলারের।
চলমান সিরিজে দল সাফল্য না পেলেও দ্যুতি ছড়াচ্ছেন অভিষিক্ত আমের জামাল। চার ইনিংসে হাত ঘুরিয়ে তুলে নিয়েছেন ১২ উইকেট। এ ছাড়া ব্যাটিংটাও একেবারে মন্দ বলা যাবে না। তৃতীয় টেস্টে দলের বিপর্যয়ের মুহূর্তে ব্যাট করতে নেমে প্রথম টেস্ট ফিফটি হাঁকালেন। শেষ পর্যন্ত খেললেন ৮২ রানের ক্যারিয়ার সেরা দারুণ এক ইনিংস। তার ব্যাটে ভর করে তিনশো পেরোয় পাকিস্তানের সংগ্রহ।
ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে পাকিস্তানের সেনসেশন
২৭ বছর বয়সে দেশের হয়ে টেস্ট জার্সি গায়ে তোলা আমের জামালের উঠে আসার গল্পটা এত সহজ ছিল না। একটা সময় সংসার চালানোর জন্য গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি টানটা একবিন্দু কমেনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পার্থ টেস্টে দলের হারের পরও নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পর নিজের সংগ্রামের গল্প জানান আমের জামাল।
অভিষেক টি-টোয়েন্টিতেই নায়ক বনে গিয়েছিলেন আমের জামাল।
পাকিস্তান ক্রিকেটের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডলে প্রকাশিত ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘অনেকে আমাকে ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দিতে বলেছিল। সবাই বলতো আমি যে ক্রিকেট খেলি তাতে কোনো আশা নেই। আর আমি বরাবর বলতাম, আশা সব সময় থাকে। তার জন্য শুধু এগিয়ে যেতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বাকিদের থেকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে।’
একটা সময় পরিবারের পুরো দায়িত্ব ছিল আমের জামালের কাঁধে। সংসারের খরচের জোগান দিতে ট্যাক্সি চালাতেও বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তার কথায়, ‘সংগ্রামই আমাকে জীবনে সময়ানুবর্তী হতে সাহায্য করেছে। সব জিনিসকে আরও মূল্য দিতে শিখিয়েছে।’
২০১৪-১৫ মৌসুমে পাকিস্তানের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছিলেন আমের জামাল। কিন্তু তারপর আর সেই অর্থে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানকার ঘরোয়া ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন। এরপর দেশের হয়ে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলার আশাও দেখেছিলেন আমের। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। অস্ট্রেলিয়া থেকে পাকিস্তানে ফেরেন। কিন্তু অনূর্ধ্ব-২৩ দলে আর সুযোগ পাননি।
ভোর ৫টা থেকে অনলাইনে রাইড বুকিং নিতেন আমের জামাল। এরপর ১০টা সাড়ে দশটা অবধি গাড়ি চালাতেন। তারপর ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত বোলিং অনুশীলন করতেন। তারপর আবার ২টা থেকে ৭টা অবধি বাকি রাইড পূর্ণ করতেন। এই সব ম্যানেজ করে চলত ফিল্ডিং ও অল্প ব্যাটিং প্র্যাক্টিসও। দুপুরে একবার খেতেন। আর রাতের খাবার কোনো সময় বাড়িতে তো কখনও আবার বাইরে যা জুটত, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতেন।
এরপর পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটি ট্যাক্সি নেন এবং সেটি চালানো শুরু করেন। সময় মতো ট্যাক্সি চালানোর ফাঁকে আমের জামাল ক্রিকেট অনুশীলনও করতেন। তিনি জানান, ভোর ৫টা থেকে অনলাইনে রাইড বুকিং নিতেন তিনি। এরপর ১০টা সাড়ে দশটা অবধি গাড়ি চালাতেন। তারপর ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত বোলিং অনুশীলন করতেন। তারপর আবার ২টা থেকে ৭টা অবধি বাকি রাইড পূর্ণ করতেন। এই সব ম্যানেজ করে চলত ফিল্ডিং ও অল্প ব্যাটিং প্র্যাক্টিসও। দুপুরে একবার খেতেন। আর রাতের খাবার কোনো সময় বাড়িতে তো কখনও আবার বাইরে যা জুটত, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতেন। পরিশ্রমই সাফল্যের মন্ত্র মেনেছিলেন আমির। আশা ছিল, একদিন পরিশ্রমের মূল্য পাবেন। তা পেয়েছেন তিনি। আমেরের কথায়, পাকিস্তান ক্রিকেট দলে জায়গা পাওয়া তার কাছে একটা বড় স্বপ্ন ছিল। এই স্বপ্নটা পূরণ করার জন্য তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন।
বলতে গেলে আমের জামাল পুরোদস্তুর একজন অলরাউন্ডার। বোলিংয়ের পাশাপাশি ভালো ব্যাটিংও করেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি জাতীয় দলেও বেশ কবার ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন। তার পেস বোলিংয়ের সাথে স্লগ ওভারে ব্যাটিং, এই প্যাকেজটা দারুণভাবে মিলে যায় পাকিস্তানের সাবেক অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাকের সাথে। আমির জামালের হাত ধরে পাকিস্তান ক্রিকেটে বহু বছর পর যেন আব্দুল রাজ্জাকেরই ছায়া ভেসে উঠছে। আমের জামাল পূর্বসূরীকে ছাড়িয়ে যাবেন নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন সেটাই আপাতত দেখার পালা।