রাজবাড়ী সংবাদদাতা:
কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষেত করেছেন, কারও আয়ের একমাত্র পথ পেঁয়াজ চাষ, কিন্তু ভেজাল বীজের কারণে জমি মরে ‘চুঁচা’ হয়ে যাওয়ায় এখন রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে রাজবাড়ীর শত শত কৃষকের। পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী- এই তিন উপজেলাতেই অন্তত এক হাজার হেক্টরের বেশি জমির পেঁয়াজ চারা মরে গেছে তথ্য দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা বলছেন, যারা বীজ সরবরাহ করেছেন তারাও পেঁয়াজ চাষি, এর আগেও কৃষক তাদের কাছ থেকে বীজ নিয়ে ভাল ফলন পেয়েছেন। তাহলে এবার কেন এমন হলো? তদন্তে নেমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এসব বীজ তিন থেকে চার বছরের পুরনো। যে কারণে ফসলের এই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় এ বছর ৩৩ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী- এই তিন উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি ‘হালি পেঁয়াজ’ উৎপাদিত হয়। এ বাইরে সদর ও গোয়ালন্দেও স্বল্প পরিমাণে এই পেঁয়াজের চাষ হয়।
সরজমিনে পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ শুধু পেঁয়াজ ক্ষেত। কেউ জমিতে সেচ দিচ্ছেন, কেউ নিড়ানি দিচ্ছেন। সবুজ পেঁয়াজ মাঠজুড়ে কৃষকের ব্যস্ততা। আবার অনেক কৃষকের জমি মরে পড়ে আছে। পেঁয়াজের চারা মরে লাল হয়ে গেছে। সেখানে কাজ করার কোনো শ্রমিক নেই। পাশাপাশি দুটি ক্ষেতের পার্থক্য দেখলেই বোঝা যায়। বালিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব মৌকুড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আকুল শেখ। এক মাস আগে ৭৫ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ করেছিলেন তিনি। এরইমধ্যে দুবার জমিতে সেচ দিয়েছেন। কিন্তু চারা বড় হওয়ার পরিবর্তে মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। চারা রোপণ ও সেচ দিতে তার প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
আকুল শেখ বলছিলেন, “আমি কোনো কোম্পানির বীজ কিনি নাই। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বীজ এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছিলাম। এর আগেও কিনছি। কিন্তু এই বীজে ভেজাল হইছে। চারা মরে গেছে। বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়লাম।” একই গ্রামের চাষি মো. হাসেম আলী শেখ বলেন, তিনি এ বছর ১২৫ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করেছিলেন। রোপণ, সেচ, নিড়ানি সব মিলিয়ে থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। “এলাকার সজিবের কাছ থেকে বীজ কিনেছিলাম। চারা লাগানোর কিছুদিন দেখি গাছ লাল হয়ে গেছে। এখন তো সব মরে ছোন হয়ে যাচ্ছে। এই যে এত টাকা খরচ করে পেঁয়াজ লাগালাম, এখন আমার এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?”
পেঁয়াজ চাষি বিপ্লব বলেন, “সজিব ভালো বীজের কথা বলে ভেজাল বীজ দিছে। আমি ৬৬ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করেছি। সব গাছ মরে গেছে। কিস্তির টাকা খরচ করে পেঁয়াজ লাগিয়ে ছিলাম। এখন সব লোকসান। আমার মত শত শত কৃষক আছে তাদেরও একই অবস্থা। আমরা সজিবের বিচার চাই।” পাংশা উপজেলার যশাই ইউনিয়নের সোমসপুর গ্রামের কৃষক আবেদ আলী মণ্ডল স্থানীয় বীজ ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম লাল্টুর কাছ থেকে দুই কেজি বীজ ১০ হাজার টাকায় কিনেছিলাম। সেই বীজের চারা ছয় পাকি জমিতে রোপণ করেছিলেন। আবেদ আলী মণ্ডল বলেন, “জমিতে লাগানোর কয়েকদিন পর দেখি চারা মরে যাচ্ছে। আমার খরচ হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এখন আমি তো খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম।”
একই এলাকার আরেক কৃষক ওহেদ আলী বলেন, “আমি ৪ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে এক কেজি বীজ কিনেছিলাম বীজ ব্যবসায়ী বকাইয়ের কাছ থেকে থেকে। সেই বীজের চারা জমিতে লাগানোর পরে সব গাছ মরে চুঁচা হয়ে গেছে।“ ওহেদ আলী আক্ষেপ করে বলেন, “আমি পেঁয়াজ চাষের জন্য এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা কিস্তিতে ঋণ নিছি। সার, শ্রমিক, চাষ দিয়ে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম পেঁয়াজ ঘরে তুলে কিস্তি পরিশোধ করবো। এখন আমার যে কাম হলো তাতে বেঁচে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” কৃষক হাকিম শেখ বলেন, “কষ্টে দিনটা পার করলেও রাত পার করতে পারি না বাপু। এনজিও থেকে কিস্তি নিয়ে লিজের জমিতে পেঁয়াজ লাগাইছি। এখন সব পেঁয়াজ মরে গেছে। আবার যে লাগাবো সেই সময়ও নাই। আমার সংসার চলবে কিভাবে? আর কিস্তির টাকা দেব কিভাবে?”
পাংশা উপজেলার যশাই ইউনিয়নের সোমসপুর গ্রামের বীজ বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম লাল্টু গত সোমবার বলেন, “আমি তিন বছর ধরে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করি। এই সময়ে বীজ নিয়ে কখনও অভিযোগ আসেনি। কিন্তু এ বছর অনেক কৃষকই বলছেন, তাদের পেঁয়াজ চারা মরে যাচ্ছে।” শহিদুল বলেন, “প্রতিবছর পাংশা উপজেলার কৃষকদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কেজি পেঁয়াজ বীজ সংগ্রহ করি। পরে সেই বীজ কৃষকদের কাছে বিক্রি করে থাকি। বীজ কিনে আনার সময় তো বোঝার উপায় নেই এটা ভালো না খারাপ। “কৃষকদের কাছ থেকে এনে যে বীজ বিক্রি করেছি সেই বীজে সমস্যা দেখা দিছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট বীজে কোনো সমস্যার কথা কোনো কৃষক বলেননি।”
পাংশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন কুমার ঘোষ বলেন, উপজেলায় আট হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছে। ভেজাল বীজের কারণে এর মধ্যে ২১৬ হেক্টর জমির পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “কৃষকেরা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, এলাকার কিছু মৌসুমী বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে এই বীজ কিনেছে কৃষকরা। যে বীজ কিনেছে সেগুলো দুই থেকে তিন বছর আগের হওয়ায় এই পরিস্থিতি হয়েছে।” কালুখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পূর্ণিমা হালদার বলেন, “এই উপজেলায় আট হাজার ৯৯২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজের কারণে ১৫০ হেক্টর জমির পেঁয়াজ ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
বালিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় ১১ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০৫ হেক্টর জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭০০-৮০০ কৃষক। রফিকুল বলেন, পাংশা-কালুখালি-বালিয়াকান্দি উপজেলায় হালি পেঁয়াজের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে একটি চক্র কৃষকের ঘরে সংরক্ষিত বীজ বলে এলাকায় ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ বিক্রি করেন। সেই বীজ কিনে কৃষকেরা এখন লোকসানের মুখে। প্রতি কেজি বীজ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দরে কিনেছেন কৃষকেরা।
তিনি আরও বলেন, “অনেক কৃষক অভিযোগ করায়, আমরা সরেজমিন তদন্ত করে ভেজাল বীজের সত্যতা পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট বিক্রেতার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে কৃষকদের বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমি ফেলে না রেখে ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।“