রংপুর প্রতিনিধি:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থানে রয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতারা। এটি দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে, এর প্রতিবাদে নগরে এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় পার্টির নেতাদের ক্ষমা চাইতে বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। একইসঙ্গে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়টি সবার সামনে এলো।
জাতীয় পার্টির বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাদের দলের দুই কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। এখন তাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলা হচ্ছে। তারা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের দোসর নয়। তারপরও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক সংলাপে না ডাকতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা তাদের জন্য অপমানজনক। এজন্য হাসনাত-সারজিসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। তাদের ওপর থেকে মিথ্যা অপবাদ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত হাসনাত-সারজিসকে রংপুরে আসতে দেবেন না তারা।
অপরদিকে, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে সোমবার (১৪ অক্টোবর) মধ্যরাতে নগরে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকরা। পরদিন মঙ্গলবার বিকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধিরা। তারা জাতীয় পার্টির এই ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। অন্যথায় রংপুরে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষার্থী রহমত আলী ও আশিকুর রহমান প্রমুখ। দুই পক্ষের এমন ঘোষণায় রংপুরে চলছে উত্তেজনা।
যা বলছেন জাতীয় পার্টির নেতারা:
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব আব্দুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে আমাদের দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি সংসদে এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ এখন আমাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলে সংলাপে না ডাকতে নিষেধ করা হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে খ্যাত রংপুর। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নির্দেশে আমাদের দলের নেতাকর্মী, ছাত্রসমাজসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ সরাসরি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি আমরা। ফলে দুই সমন্বয়কের এই ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা তাদের অনুরোধ করবো, যেন আমাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ তুলে নেন তারা।’
মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাতীয় পার্টি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সারা দেশে ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আন্দোলনে গিয়ে আমাদের দুই কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন হলেন অটোরিকশাচালক নগরীর ঘাঘট পাড়া মহল্লার জাতীয় শ্রমিক পার্টির কর্মী মানিক, অপরজন মহানগরের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মী মেরাজুল ইসলাম। আহত হয়েছেন আমাদের শতাধিক নেতাকর্মী। জাতীয় যুব সংহতি ও জাতীয় ছাত্র সমাজের চার নেতাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তারা ১৭ দিন কারাগারে ছিলেন। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় যে ২৩টি মামলা হয়েছিল, সবগুলোতে জাতীয় পার্টি ও অঙ্গসংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। এরপরও দুই সমন্বয়ক জাতীয় পার্টিকে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের দোসর ও মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালাল বলে উল্লেখ করেছেন। এটি আমাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। দুই সমন্বয়ক তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি আমরা। এটি জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। তাদের রংপুরে কোনও অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না। আমরা এই সিদ্ধান্ত যেকোনোভাবে বাস্তবায়ন করবো।’
এসএম ইয়াসির আরও বলেন, ‘সম্প্রতি সমন্বয়ক সারজিস আলমের রংপুরের সমাবেশ ঘিরে ঝামেলা তৈরির আশঙ্কা ছিল। তখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমানকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে সমাবেশটি শান্তিপূর্ণভাবে করতে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। মোস্তাফিজারের নির্দেশে আমাদের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে সারজিসের ওই সমাবেশে পাহারা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সাবেক মেয়র সমাবেশের অদূরে মাইক্রোবাসে বসে সমাবেশ যাতে সুন্দরভাবে হয়, সে সহযোগিতা করেছেন। সমাবেশের পর সারজিস সাবেক মেয়রকে ফোন করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এখন সেই ব্যক্তি বড় বড় কথা বলেন। আমাদের আওয়ামী সরকারের দোসর ও মেরুদণ্ডহীন বলেন। এই দুঃখ কাকে বলবো আমরা।’
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই সমন্বয়ককে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণার সিদ্ধান্ত জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। এখানে সমন্বয়কদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনও বিরোধ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ। এটি সবার জানা। আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক আছেন। আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি রাখি। আমাদের দুর্বল ভাবার কোনও কারণ নেই। যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করবেন আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী।’
সোমবার রাতে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান। নগরের সেন্ট্রাল রোডে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে এক সভায় এ ঘোষণা দেন তিনি। জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির এই যৌথ সভায় দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের উপস্থিত ছিলেন।
যা জানালেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুরের প্রতিনিধি ইমরান আহমেদ বলেন, ‘ছাত্র-জনতার মুক্তির লড়াই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহরা চব্বিশ বিপ্লবের নায়ক। তাদের অবাঞ্ছিত করার এখতিয়ার জাতীয় পার্টির নেই। এজন্য তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। না হয় কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবো আমরা।’
মঙ্গলবার মানববন্ধনে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রহমত আলী বলেন, ‘আমরা আজকের এ মানববন্ধন থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, জাতীয় পার্টিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতির কাছে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। তাদের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে।’
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী রুমন বকশি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আবু সাঈদের সহযোদ্ধারা বেঁচে থাকতে কোনও দালাল ও ফ্যাসিস্টদের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে দেবো না। জাতীয় পার্টির নেতার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করে অনতিবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে।