বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, ‘আমি কখনও দরবেশ হবো না। যদি আমি তাই হতে চাইতাম, তাহলে আমার জীবনে অনেক সুযোগ ছিল তখন হই নাই, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর নয়াপল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘কনভারসেশন উইথ ইআরএফ মেম্বারস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কাজ করছে জানিয়ে আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশের অর্থনীতিতে আরও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিগত সরকারের দলীয়করণের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। সে সময় সরকারের কর্মকর্তারা লুটপাটে ব্যস্ত ছিল। তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলেছিল।
তিনি বলেন, কর্মকর্তারা পরিসংখ্যান ও তথ্য ভুল দিয়ে লুটপাট করে গেছে। তাই এখন আর হিসাব মেলানো যায় না। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে। পতিত সরকার তার আগের সরকারের থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশি সক্ষম জাহির করতে বেশি বেশি দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়েছিল, যা অনৈতিক।
অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘বিভিন্ন আলোচনা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনাকে বর্তমান সময়ের সালমান এফ রহমান মনে করা হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? জবাবে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘আমি কখনও দরবেশ হবো না। যদি আমি তাই হতে চাইতাম, তাহলে আমার জীবনে অনেক সুযোগ ছিল। দরবেশ সাহেব থেকে আরও বেশি ক্ষমতাবান ছিলাম এক সময়। এটা অনেকে সাক্ষী দেবে। তখন দরবেশ সাহেবরা কিছুই ছিল না। তখনও ওই ক্ষমতা অপব্যবহার করে আমি উপকৃত হই নাই, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও এরশাদ সরকার- কোনো সময়ই আমি কখনও সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করিনি। টুকটাক যেটুকু ব্যবসা করেছি, নিজে নিজেই করেছি।’
পুঁজিবাজারে নতুন কোনো দরবেশের আবির্ভাব হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমি কখনও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করিনি এবং পুঁজিবাজার থেকে কোনো মুনাফাও করিনি।
‘তবে কিছু কিছু লোক পুঁজিবাজারকে লটারিতে পরিণত করেছে। তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে শেয়ার কেনা-বেচা করছে। তারা মনে করে, আজ যে শেয়ার কিনবো, ক’দিন পরেই তার দাম বাড়বে। তখন বিক্রি করে মুনাফা করবো’— বলেন তিনি।
বেক্সিমকো গ্রুপের কেন বিক্রি করা হবে, সেই প্রশ্ন রেখে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক যদি অন্যায় করে থাকে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া উচিত। আইন না মেনে বা আইনের অপব্যবহার করে আপনি কাউকে দোষারোপ করেন, সেটার পক্ষে আমি না। বেক্সিমকোর যে প্রতিষ্ঠানগুলো শুনতেছি বিক্রি করে দেবে, কারা বিক্রি করবে, কেন বিক্রি করবে?
‘এ প্রতিষ্ঠানে তো ৮২ হাজার লোক চাকরি করে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি চাই, কোনো উৎপাদনশীল খাতে সরকার এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে, যাতে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে।’
মিন্টু বলেন, যদি বেক্সিমকো প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা কোনো অন্যায় করে থাকে, তাদের বিচার হউক- এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলবো না। কিন্তু সরকারের এমন কোনো কাজ করা উচিত না, যে কাজে এই ফ্যাক্টরিগুলো বা উৎপাদনমুখী কোনো শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়। প্রতিষ্ঠান কখনও অন্যায় করতে পারে না, মালিক অন্যায় করতে পারে। তাই মালিকের শাস্তি হতে পারে, প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়।
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন যে ঋণ খেলাপি আছে, ২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এটা আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, উৎপাদনশীল খাতের সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান হয়নি। এখনও সব জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা ঠিকমতো কাজ করছে না। ব্যাংকের সমস্যা আছে, সে কারণে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক নিত্যনতুন সার্কুলার জারি করতেছে, তাতে খেলাপি ঋণ কমার কোন সুযোগ আমি দেখছি না।
‘আমাদের প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ ছিল গড়ে ১৩-১৪%, সেটা এখন কমে হয়েছে ৮%। এটা খুবই বিপজ্জনক এবং ভবিষ্যতের জন্য একটা বিপদসংকেত। এ থেকে স্পষ্ট যে, দেশে কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে?’
ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মিন্টু বলেন, ‘এভাবে অন্যায়ভাবে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা আমি নিজেও পছন্দ করি না। সমাজকে শক্তিশালী করতে হলে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে, আপনার ইচ্ছা আরেকজনের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিচ্ছেন। এটা আমি পছন্দ করি না, এটা আইনসিদ্ধও না। এটা কোর্টের প্রসেসে হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে তো বিনা কেসে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া যায়।’
‘একজনের বিরুদ্ধে তদন্তে যদি যথাযথ প্রমাণ থাকে, তাহলে ফ্রিজ করেন’— বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা পাওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে জানিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এজন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচিত সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। এখন আমরা কার কাছে গিয়ে কি বলবো?
মূল্যস্ফীতির জন্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কতটা দায়ী, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২-৩টা ইস্যুতে সিন্ডিকেট হতে পারে। তা হলো ভোজ্যতেল, চিনি, ভুট্টা ও গম। এগুলো বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়, এতে ১০ মিলিয়ন, ২০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতে হয়। তাই ছোট ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারেন না। কিছু বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এগুলো আমদানি করে, তারাই ব্যাংকে সবচেয়ে বড় বড় ঋণ খেলাপি।
মূল্যস্ফীতির জন্য ১৬-১৭টি কারণ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু মুদ্রা সরবরাহ সংকোচন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বলে উল্লেখ করেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। আর মুদ্রানীতির বেশি ব্যবহার করায় ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। তখন পণ্য সরবরাহ আরও কমবে। তাতে দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে কিছুটা হলেও এখন সরে আসছে।
মিন্টু বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বেসরকারিখাতের বিদেশি মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি ডলার। আর ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এটি বেড়ে হয়েছে ২৩০০ কোটি ডলার। এসব ঋণ স্বল্পমেয়াদি ও উচ্চ সুদের। যখন ঋণ নিয়েছে, তখন এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ৮০-৮৪ টাকা, বর্তমানে ১২২ টাকা। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ঋণগ্রহীতা এসব ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। পরিণতিতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে।