আজিমুল হক:
অনেকের ধারণা হচ্ছে মানুষ সারাদিন সেজদাহ অবনত হয়ে থাকুক এমনটা আল্লাহ চান। অনেকের ধারণা হল আল্লাহ মানুষের কাছে চান, মানুষ কথায় কথায় আল্লাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হোক, রাত জেগে সেজদায় পড়ে থাকুক, আল্লাহর গুণকীর্তন করুক, যিকির-আজকার করুক। অর্থাৎ আল্লাহর মহত্ত্ব শ্রেষ্ঠত্ব, বিশালতার প্রচার করুক ও বিশ্বাসী হোক এমন চাওয়া আল্লাহর। এমন ধারণা থেকে মুসলিম জাতি সেই স্থানগুলোই পছন্দ করেছেন যে স্থানগুলো থেকে সেজদায় অবনত থেকে যিকির-আজগার করা যায়, আল্লাহর গুণকীর্তন করা যায়।
যারা এরকম ধারণা পোষণ করে থাকেন তাদের ধারণা কতটুকু যৌক্তিক এবং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য সেটা পরিষ্কার হওয়া জরুরি। যখন আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করলেন তখন মালায়েকরা একটা কথা উত্থাপন করলেন। তারা বললেন, মানুষ পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করবে অর্থাৎ অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত করবে। আপনার গুণকীর্তন করার জন্য মালায়েকরাই কী যথেষ্ট নয়? তাহলে নতুন সৃষ্টির কী প্রয়োজন (সুরা বাকারা ৩০)। তখন আল্লাহ বললেন, আমি জানি, তোমরা জানো না। এ কথোপকথন থেকে এটা সুস্পষ্ট যে মানুষকে আল্লাহ তাঁর গুণকীর্তন করার জন্য সৃষ্টি করেন নাই। আল্লাহর লক্ষ কোটি সৃষ্টি রয়েছে যারা আল্লাহর গুণকীর্তন করছে, তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করছে। এ কারণে আর নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন নেই।
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন খলিফা হিসেবে, খলিফা অর্থ প্রতিনিধি। এজন্য আশঙ্কা যে তারা ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ বললেন, তিনি যা জানেন মালায়েকরা তা জানেন না। তিনি কী জানেন সেটা সূরা বাকারার ৩৮ নাম্বার আয়াতে তিনি প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, যুগে যুগে তিনি হেদায়াহ পাঠাবেন। যারা সেই হেদায়াহ অনুসরণ করবে, যারা হেদায়াহর দিক-নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনা করবে, তাদের কোনো দুঃখ নেই, তাদের কোনো ভয় নেই, তাদের কোনো আশঙ্কা নেই। কিসের আশঙ্কা নেই? ঐ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করার আশঙ্কা নেই। অর্থাৎ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা (অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত) থেকে বাঁচার উপায় হল হেদায়াহ। মানুষের কাছে আল্লাহ এটাই চান যে মানুষ হেদায়াহর উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে মালায়েকদের উত্থাপিত কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে দিক, ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় নিমজ্জিত না হোক। মানুষের কাছে আল্লাহর চাওয়াই হল তারা যেন ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমার মধ্যে অর্থাৎ অনৈক্য করে, অন্যায়-অবিচার করে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত করে ধ্বংস না হয়ে হেদায়াতের আলোয় আলোকিত হয়ে, সমস্ত ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে।
আপনি কি চাইবেন আপনার পাঁচ সন্তানের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি হোক? নিশ্চয়ই চাইবেন না। তারা সবাই আপনার গুণকীর্তন করে, প্রশংসা করে, এলাকায় বলে বেড়ায় যে আপনি অনেক ভালো, কিন্তু বাড়ি ফিরে পাঁচ ভাই মারামারি করে এটা কি আপনার পছন্দ হবে? পছন্দ হবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহও পছন্দ করেন না যে তাঁর সৃষ্টি মানুষ নিজেরা নিজেরা মারামারি করে, কাটাকাটি করে ধ্বংস হোক। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন তাই তাদের পক্ষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ করা খুবই স্বাভাবিক। তারা যেন তা না করে এজন্য তিনি একটা পথ দিয়েছেন। সেই পথটা হল হেদায়াহ। যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে আল্লাহ সেই হেদায়াহ (জীবন পরিচালনা করার সঠিক পথনির্দেশনা) প্রেরণ করেছেন। এবং বিপথগামী জনগোষ্ঠীকে সেই হেদায়াহ দান করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যেকার সমস্ত অসঙ্গতি দূর করে সাম্য-মৈত্রী, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সুবিচার, সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরিণতিতে যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটাই আল্লাহর চাওয়া, সেই লক্ষ্যেই সকল নবী-রসুল অক্লান্ত সংগ্রাম করেছেন। এখন মানুষ যদি আল্লাহর সন্তুটি লাভ করতে চায়, আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চায় তবে মানুষকে অবশ্যই মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। আর আল্লাহ মানুষের কাছে এটাই চান যে মানুষ তাঁর দীন দিয়ে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে শান্তিতে বসবাস করুক।