মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল যখন মোশরেক আরবদের একেবারে প্রাণকেন্দ্র মক্কায় দাঁড়িয়ে তওহীদের ঘোষণা দিলেন- তাঁর সেই ঘোষণা কোরাইশ গোত্রপতি ও ধর্মব্যবসায়ীদের কায়েম করে রাখা স্বার্থের ইমারতে প্রচণ্ড আঘাত হানলো। আল্লাহর রসুল ও তাঁর অনুসারীরা নিশ্চয়ই জানতেন তারা কোথায় আঘাত করেছেন এবং সেই আঘাতের প্রত্যাঘাত আসবে, আজ নয়তো কাল। প্রত্যাঘাত আসতেই হবে, কারণ যুগ যুগ ধরে যে বিকৃত ধ্যান-ধারণা ও অন্ধত্বের চর্চা চলে আসছে এবং তার ভিত্তিতে যে কায়েমী স্বার্থের প্রাসাদ গড়ে উঠেছে, সেই প্রাসাদের রক্ষীরা সুবোধ বালকের ন্যায় হাসিমুখে সত্যকে মেনে নিবে না। বাধা দেবে, হুমকি দেবে, ভয় দেখাবে, রক্ত ঝরাবে, এমনকি নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তেড়েফুড়ে আসবে মুণ্ডুপাত করতে। এই সময় তাদের প্রত্যাঘাতে ভয় না পেয়ে, পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে, আল্লাহর উপর ভরসা করে যারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবে, আঘাতের পর আঘাত করতে পারবে বিজয় তাদের জন্যই। মূলত এখানেই মো’মেনের পরীক্ষা- হাজারো বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে গন্তেব্যের দিকে অবিরাম ছুটে চলা, সর্বাবস্থায় লক্ষ্যে স্থির থাকা, অটল থাকা- এ সহজ কাজ নয়!
ইতিহাস সাক্ষী আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবগণ অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের রক্তক্ষরা সেই দিনগুলো কতই না সবরের সাথে অতিবাহিত করেছিলেন! অবশ্য সেই সবর বর্তমানের বিকৃত আকীদার সবর ছিল না। বর্তমানে “সবর” শব্দটির অর্থ করা হয় ধৈর্যধারণ করা, চুপচাপ সহ্য করা ইত্যাদি। শব্দগুলি শোনার সঙ্গেই মনে একটা জড়তা, অসাঢ় ভাবের সৃষ্টি হয়, ইংরেজীতে যাকে বলে চধংংরাব নিস্ক্রিয়। কিন্তু সবর শব্দের আসল অর্থ, যে অর্থে আল্লাহ ও রসুল (সা.) ব্যবহার করেছেন তা বর্তমানে চালু অর্থের ঠিক বিপরীত। প্রচণ্ড গতিশীল (উুহধসরপ) ইসলামকেই যেমন স্থবির (ঝঃধঃরপ) করে ফেলা হয়েছে, তেমনি কোর’আনের সবর শব্দটার অর্থকেও নিষ্ক্রিয় (চধংংরাব, রহবৎঃ) অর্থে নেয়া হচ্ছে। এর প্রকৃত অর্থ হলো কোন উদ্দেশ্য অর্জন করতে অটলভাবে সমস্তকিছু সহ্য করা। যত বাধা আসুক, যত বিপদ-আপদ আসুক, যত কষ্ট হোক, কিছুতেই হতাশ না হয়ে, ভেঙ্গে না পড়ে সুদৃঢ়ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই সবরের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আল্লাহর রসুল।
আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে অপমান, কটুক্তি, তিরস্কার থেকে আরম্ভ করে শারীরিক নিগ্রহ- কোনটিই বাদ রাখেনি কোরাইশরা। তারপরও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে এক বিন্দুও নড়াতে পারেনি তাঁকে। তাঁর পদযুগল শিথিল হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। নবুয়তের একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক।
আল্লাহর রসুল কাবা প্রাঙ্গনে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নাই। তাঁর কণ্ঠ থেকে উৎসারিত তওহীদের ঝংকারে কাবাঘর হয়ে উঠল মুখরিত- ওদিকে কোরাইশ ধর্মব্যবসায়ীদের পড়ল মাথায় হাত! তারা বুঝে গেল- ‘কী সর্বনাশটাই না হয়ে যাচ্ছে তাদের! এই তো এখনই, তাদের শত ব্যস্ততার ফাঁকে, শত কোলাহলের মধ্যে, একটি কণ্ঠে গর্জে উঠল তওহীদের বজ্রনিনাদ- এ কেবল শব্দ নয়, এ যেন ধর্মব্যবসার মৃত্যুবীন! না- কখনই না, হুকুমদাতা আল্লাহ নন, এমনকি হুকুমদাতা কাবার মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-কাঠ-পাথরের ওই প্রাণহীন জড়মূর্তিও নয়, হুকুমদাতা আমরাই। আমাদের হুকুমেই সমাজ চলবে, আমরাই ইলাহ, আমরাই সর্বাধিপতি। মুহাম্মদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে হবে। আজ! এখনই!’
চতুর্দিক হতে ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিতরা বের হয়ে আসলো। দলে দলে ছুটে এলো তাদের ধর্মান্ধ অনুসারীরা। হারাম শরীফ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। জনমনে চাপা উত্তেজনা- না জানি কী হয়! ধর্মব্যবসায়ীরা আল্লাহর রসুলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। যেন বিরাট এক অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা হচ্ছে। সবাই মিলে রসুলকে (সা.) তিরস্কার করতে লাগলো এবং সরাসরি আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎবেগে। আম্মা খাদিজার বাড়িতেও পৌঁছে গেল। বাড়িতে ছিলেন আম্মা খাদিজার পূর্বস্বামীর ঔরসজাত পুত্র, তরুণ যুবক হারিছ। হারিছ ছুটে গেল রসুলকে উদ্ধার করতে। ধর্মব্যবসায়ীরা তাকে উপস্থিত হতে দেখে তার উপরেও হামলা চালালো হিংস্র হায়েনার মত। রসুলাল্লাহ এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেন, কিন্তু হারিছ প্রাণ হারালেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম রক্তক্ষরণের ঘটনাটি ঘটল। (হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা: সমকালীন পরিবেশ ও জীবন)
আল্লাহর রসুল যখন লোকজনের সাথে তওহীদের আলোচনা করতেন, তাঁর পেছনে পেছনে যেত মোশরেকরা। এদের একজন ছিল নজর ইবনে আল হারিস। রসুল (সা.) যখনই কোনো আলোচনায় আল্লাহর উলুহিয়াতের কথা বলতেন, মুক্তির পথ তুলে ধরতেন এবং পূর্ববর্তী জাতিগোষ্ঠীগুলোর ধ্বংসের কথা বলে মানুষকে সতর্ক করতেন- তাঁর কথা শেষ হতেই সে বলে উঠত- ‘ওহে লোকেরা! আল্লাহর কসম, আমার চাইতে মোহাম্মদ ভালো গল্প বলতে পারে না। তোমরা আমার গল্প শোনো।’ এই বলে সে বীর রুস্তম ইসফান্দিয়ার ও পারস্যের রাজাদের কাহিনী শোনাতো। (সিরাত ইবনে হিশাম) বলা বাহুল্য, লোকজন তার বক্তব্য যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই শুনত। ফলে রসুল (সা.) এর তওহীদের আলোচনা জনমনে যে রেখাপাত করত, তা নিমিষেই উধাও হয়ে যেত।
রসুলাল্লাহ কোনো একটি বক্তব্য শুরু করলেই তাদের আলেমরা বিভিন্ন অজুহাতে কথার মধ্যে বাগড়া দিত এবং বদানুবাদ শুরু করত। তারা অন্যদেরকেও প্ররোচনা দিত যেন রসুলাল্লাহর কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে না শুনতে পারে। তার বক্তব্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার হেন প্রচেষ্টা নেই তারা করেনি। কাউকে রসুলাল্লাহর কথা শুনতে দেখলে তাকেও কটুক্তি ও অপমান করা হত।
একদিন উবায় ইবনে খালাফ নামের একজন ব্যক্তি রসুলাল্লাহর কথা শুনছিল। তার বন্ধু উকবা ইবনে আবু মায়াইতের কাছে সেই খবর পৌঁছে গেল। উকবা ছিল রসুলাল্লাহর চরম শত্রু। কাউকে রসুলাল্লাহর বক্তব্য শুনতে দেখলেই সে আতঙ্কিত হয়ে উঠত। যখন সে জানতে পারল তার বন্ধু উবায় রসুল (সা.) এর বক্তব্য শুনেছে, সে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে গেল বন্ধুর কাছে।
সে জিজ্ঞাসা করল- ‘তুমি নাকি মুহাম্মদের সঙ্গে বসে তার কথা শুনেছো? আল্লাহর কসম, তুমি যদি তার মুখে থুতু ফেলে না আসো তাহলে আর কোনোদিন তোমার মুখ দেখব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’
এই কথা শুনে উবায় সত্যিই রসুলাল্লাহকে থুতু দিয়ে আসে। আল্লাহর লানত কুড়িয়ে নেয় নিজ হাতে। তাদের দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ আয়াত নাজেল করেন- ‘যেদিন সীমা লঙ্ঘনকারী আপন দুই হাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে- হায়! আমি যদি রসুলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতাম’।
আল্লাহর রসুল যেদিন প্রকাশ্যে বালাগ আরম্ভ করেন সেদিন থেকেই মক্কার ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ও তাদের অন্ধ অনুসারীদের কটুক্তি আর অপমান তাঁকে ঘিরে রাখে। তিনি সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সমবেত মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে তওহীদের আহ্বান জানালে সর্বপ্রথম তাঁর আপন চাচা আবু লাহাবই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। রসুলাল্লাহর (সা.) ‘‘সর্বনাশ’’ কামনা করে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত আবু লাহাব রসুল (সা.) এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও লোকজনকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে। তার স্ত্রীও তার মতই রসুলের (সা.) সাথে চরম দুশমনি আরম্ভ করে। আল্লাহর রসুলের সাথে শত্রুতা তাদেরকে এমন জঘন্য কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত করে যে, এক পর্যায়ে পবিত্র কোর’আনে এই দম্পতিকে অভিসম্পাত দিয়ে আল্লাহ সুরা লাহাব নাজেল করেন। আবু লাহাবের স্ত্রী, ইন্ধন বহনকারী উম্মে জামিল যখন শুনল তার ও তার স্বামী সম্পর্কে কোর’আনে আয়াত নাজেল হয়েছে, তখন সে আরও ক্ষেপে গেল। সে হয়ে উঠল হিংস্র জন্তুর মতো।
একটি পাথরের নোড়া নিয়ে উম্মে জামিল ছুটে চলল রসুল (সা.) এর সন্ধানে। সে সময় কাবা প্রাঙ্গনে রসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.) বসে ছিলেন। কিন্তু এই জাহান্নামী নারীর দৃষ্টি থেকে আল্লাহ তাঁর রসুলকে হেফাজত করলেন। সে আবু বকর (রা.)কে দেখতে পেল, কিন্তু তার পাশেই রসুলকে দেখতে পেল না। আবু বকর (রা.) কে বসে থাকতে দেখে সে বলল, ‘আমি জানলাম মুহাম্মদ আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে, আল্লাহর কসম, তাকে পেলে আমি এই পাথর দিয়ে তার মুখ থেঁতলে দিব।’ সে বিভিন্ন অশালীন শব্দ উচ্চারণ করে রসুলকে গালাগালি করতে থাকল।
আরেক ব্যক্তি ছিল উমাইয়া ইবনে খালাপ। সে রসুলকে (সা.) দেখলেই অকথ্য ভাষায় গালি দিত। রসুলের (সা.) বিরোধিতায় আরও অগ্রগণ্য ছিল ইবনুল আসদা আল হুদালি, আদি ইবনে হামরা আস সাকাফি। এরা আল্লাহর রসুলের দিকে লক্ষ্য করে ভেড়ার জরায়ু ছেড়ে মারত। কেউ আবার রসুলাল্লাহর খাবার প্রস্তুতের সময় রান্নার পাতিলে ছুঁড়ে মারত। তারা যখন নোংরা কিছু তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারত, তিনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে সেটাকে কাঠিতে করে তুলে নিয়ে সেই লোকের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেন। বলতেন, ‘এটা কী ধরনের আশ্রয় আমাকে দিচ্ছেন হে বনু আবদু মানাফ?’ এই বলে তিনি সেটা রাস্তায় নিক্ষেপ করতেন। এছাড়াও রসুল (সা.) এর ঘরে প্রায়ই ঢিল-পাথর ছোঁড়া হত। রসুল (সা.) যখন কাবায় মোশরেকদের থেকে পৃথক হয়ে নামাজ পড়তেন, তখন কোরাইশরা এমনভাবে দাঁড়াত যা রসুলাল্লাহকে দেয়ালের সাথে কোনঠাসা করে ফেলত। সেই সাথে কটুক্তি, তিরস্কার, এমনকি শারীরিক নিগ্রহ তো আছেই।
(পাঠকদের বিভ্রান্তি নিরসনে বলে রাখা প্রয়োজন- বর্তমানে আমরা যেই পদ্ধতিতে নামাজ পড়ি, সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে আরম্ভ হয় রসুলের মদীনায় হিজরতের পর। ইসলামের প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় মদিনায়। প্রথম আজান হয় মদিনায়। প্রথম জুমাও হয় মদিনায়। মাক্কী জীবনে আল্লাহর রসুল ও তাঁর অনুসারীদের একমাত্র কর্তব্য ছিল কেবল নিরবচ্ছিন্নভাবে তওহীদের প্রচারকার্য। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, বাৎসরিক হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি বিধান অনেক পরে এসেছে- একটি জনগোষ্ঠীর আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার পর। তবে স্মর্তব্য যে, মক্কার কোরাইশরা কিন্তু আল্লাহকে বিশ্বাস করত। তারা নিজেদেরকে মনে করত মিল্লাতে ইবরাহীম (ইব্রাহীমের জাতি) এবং ইবরাহীম (আ.) এর দেখানো পদ্ধতিতে নামাজও পড়ত। আল্লাহর রসুলের উপর বর্তমানের পদ্ধতিতে নামাজ ফরদ হবার আগ পর্যন্ত তিনিও কাবায় গিয়ে কোরাইশদের মতো নামাজ পড়তেন- তবে সত্য বোঝার পর তিনি যেহেতু কোরাইশদের বিকৃত ধর্মপালন থেকে হিজরত করেন, তাদের দলত্যাগ করেন, কাজেই তিনি নামাজের সময় তাদের সাথে একযোগে নামাজ না পড়ে, তাদের থেকে আলাদা হয়ে একাকী নামাজ পড়তেন।)
কিন্তু এতকিছু গায়ে না মেখেও আল্লাহর রসুল কাবাঘরে আসতেন, লোকজনকে ধরে ধরে তওহীদের কথা শোনাতেন- এটা কোরাইশদের খুব যন্ত্রণা দিত। আবু তালিবের সমর্থনের কারণে তারা না পারছে রসুলকে হত্যা করে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে, আবার না পারছে নীরবে তওহীদের বাণী হজম করতে। তাদের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভাঙতে থাকে। এতকিছু করেও, এত অপমান, তিরস্কার ও বিদ্রুপের পরও এই লোকটি তার কথায় ও মতের উপর অটল হয়ে আছে- এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারত না। তাদের ব্যর্থতা রূপ নিতে লাগলো উগ্রতায়। (চলবে . . .)