তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশে সারের উৎপাদন না বাড়লে আগের মতোই বেশি দামে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। আর গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা দেশীয় কারখানায় সার উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ইউরিয়া সার উৎপাদনে দেশের কারখানাগুলো সক্ষমতার পথে হাঁটছে। কিন্তু গ্যাস সঙ্কটে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সচল থাকা দেশের অন্য দুটি সার কারখানা এবং মজুত সার দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) দেশে সারের উৎপাদন আরো বাড়াতে কারখানাগুলো সংস্কার করছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সূত্র মতে, দেশে প্রতিবছর সাড়ে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে ৪টি সার কারখানা থেকে প্রতিবছর ১০ লাখ টন উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) থেকে মিলছে ৬ লাখ টন সার। আগামী বছরের নভেম্বরের মধ্যে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানাটি নতুন করে চালু হলে তাতে আরো ৯ লাখ ২৪ হাজার টন সার উৎপাদন বাড়বে। আর পুরাতন সার কারখানাগুলো সংস্কার করায় ৫ থেকে ৬ লাখ টন সারের উৎপাদন বাড়বে। তাতে চাহিদার পুরো ইউরিয়া সার দেশেই উৎপাদন করা যাবে।
সূত্র জানায়, বিগত ১ জুন থেকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সার খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দর ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করেছে। তাতে প্রতি টন সার উৎপাদনে খরচ বেড়েছে ১৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। গত জুনে জামালপুরের যমুনা ফার্টিলাইজার কারখানায় (জেএফসিএল) ২ কোটি ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৫৪ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। সেজন্য ৩০ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ১০৪ টাকা অতিরিক্ত বিল গুনতে হবে। গ্যাসের দর বাড়ায় অতিরিক্ত টাকা সরকার পরিশোধ না করলে কারখানাগুলো চালু রাখা কঠিন হবে। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৯ টাকা। অথচ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি কেজি সার ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে কেনা হয়েছে। তাতে গত অর্থবছরে শুধু ইউরিয়া সার আমদানি বাবদ খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। প্রতি কেজি সার উৎপাদনে ১৯ টাকা খরচ হলেও কৃষক কিনতে ১৪ টাকায় পারছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে সার সরবরাহ করতে গিয়ে বিসিআইসি বছরে গড়ে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে। কিন্তু সংস্থাটি লোকসানের ওই টাকা সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে না। যদিও অভিযোগ রয়েছে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে কৃষকের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছে সার। সারাদেশ থেকেই ওই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ অধিকাংশ জেলায় ১৪ টাকার ইউরিয়া সার ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পর্যাপ্ত সার ব্যবহারের ফলে ২০২০-২১ সালে দেশে মোট দানাদার শস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৫৫.৫ লাখ টন। তার মধ্যে চাল, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, পেঁয়াজ ও পাটের মতো ফসল রয়েছে। ইউরিয়া সার গাছের বর্ধন শক্তি বাড়ায়। টিএসপি ও ডিএপি গাছের কাণ্ড শক্তিশালী করে ফসল উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। আর এমওপি গাছের দৃঢ়তা বাড়িয়ে তোলে।
সূত্র আরো জানায়, বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হওয়ায় গত অর্থবছরে সরকার সারের পেছনে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এক টন ইউরিয়া সার ৫০০ ডলারে কিনলেও এখন তা ৮০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। টিএসপি সারের দাম ২০০-৩০০ ডলার থাকলেও তা বেড়ে ৬০০-৭০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে সরকারকে বেশি দামেই সার কিনতে হচ্ছে। আবার করোনার কারণে ওই শিল্পও চাপের মুখে পড়েছে। অনেক দেশ নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে সার রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে। চীন বিশ্বের ডিএপি সারের প্রধান রপ্তানিকারক হলেও দেশটি ওই সারের রপ্তানিতে এ বছর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন বাড়ানো গেলে ঝুঁকি কমবে। তবে চলমান গ্যাস সঙ্কটের মধ্যেও দেশে ৭ লাখ টনেরও বেশি সার মজুত আছে। দেশের বৃহৎ কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে (সিইউএফএল) গ্যাস সংকটে বন্ধ হয়ে গেলেও মজুত সার দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানো যাবে। ফলে আসছে আমন মৌসুমে সার পেতে সমস্যা হবে না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ জানান, বাংলাদেশে জমি সীমিত। সারের ব্যবহারের কারণেই জনসংখ্যার সঙ্গে মিল রেখে দেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। দেশের খাদ্যের চাহিদার বেশিরভাগ দেশেই হচ্ছে। ফলে সার ব্যবহার রাতারাতি বন্ধ করে দিলে তা ফসল উৎপাদনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানান, আমদানির চেয়ে দেশে উৎপাদিত সারের দাম অনেক কম। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে সার কারখানাগুলো চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ওসব নিয়ে সরকার অনিশ্চয়তায় রয়েছে। সার কারখানার বাড়তি গ্যাসের দাম পরিশোধের ব্যাপারে অর্থ, শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। আর দেশে টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের যে মজুত আছে, তাতে আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপে বিকল্প উৎস কানাডা থেকে সার আনা সম্ভব হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতি আগামী দুই মাসের মধ্যে ঠিক হলে সবকিছু স্বাভাবিক করা সম্ভব।
এ বিষয়ে বিসিআইসির চেয়ারম্যান শাহ্ মো. ইমদাদুল হক জানান, কয়েক বছরের তুলনায় দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা চালুর পর সার আমদানি করতে হবে না। দেশে সারের ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। তারপরও সরকার সার উৎপাদনে কোনো খরচ দিচ্ছে না। তার মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমন অবস্থায় সরকার টাকা না দিলে গ্যাসের দাম দেয়া সম্ভব হবে না।