স্টাফ রিপোর্টার:
চালের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। আর চালের বাজার পরিস্থিতি অর্থনীতির সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছরে দেশে চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যদিও চাল উৎপাদনকারী দেশের বৈশ্বিক তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও অন্তত ৭০ শতাংশ বেশি বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকা ও রুপির বিনিময় হারে অসম পরিবর্তনসহ নানা কারণে বর্তমানে ওই পার্থক্য কিছুটা কমতে পারে। দেশের বাজারে চালের পাইকারি দাম প্রতি টন ৫৭০ ডলার আর প্রতিবেশী ভারতে তা ৩৩৫ ডলার। আমদানিনির্ভর হওয়ায় বিভিন্ন সময়েই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখিতার জন্য ভারতের বাজার অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করা হয়। তবে বর্তমানে চালের মজুদ বাড়াতে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনা হয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত করার পরও ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি টন চালের আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৪১৯ ডলারে, যা বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারের মূল্যের চেয়ে অনেক কম। খাদ্যপণ্য বাজার সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাজারে এ মুহূর্তে দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও চালের বিদ্যমান মজুদ ও আমদানির পাশাপাশি আগামী বোরো মৌসুমের উৎপাদন বাজারের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি ও পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর খুচরা বাজারে চালের দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। দেশের বাজারে চালের দাম এখনো বেশ অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আর শুধুমাত্র চালের দামের কারণেই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায়ই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বাজারে চালের দাম বারবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে পর্যবেক্ষকরা প্রধানত সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছে। তাদের মতে, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবেই চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। এ মুহূর্তে বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সামনের দিনগুলোয় চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বড় আশঙ্কার অনেক সুযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীরা চালের দাম বারবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়াকে দায়ী করছে। তাদের মতে, অর্থায়নসহ নানা বৈষম্যের কারণে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। ফলে বৃহদায়তনের ব্যবসায়ীরা আরো বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেও বহু চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। গত বছরের আমন মৌসুমে দেশে চালের বেশ ভালো উৎপাদন হয়েছিল। বোরো মৌসুমেও ভালো ফলন হয়েছিল। কিন্তু গত জুনে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে আউশ মৌসুমের আবাদ কমে যায়। আবার একই সময়ে বাজারও মারাত্মক অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে জুনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয় সরকার। এ সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবু আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু বারবার শুল্ক কমানোর পরেও ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে পর্যাপ্ত মাত্রায় চাল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, চালকল মালিকদের বাজারের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণই চালের বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি এবং ভারতে শুল্ক আরোপও দেশের বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। তাছাড়াও চালের দাম বেশি হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সম্প্রতি বৈশ্বিকভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়া। ইতোমধ্যে ২৫টি দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দাম বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো পরিবহন খরচ। মূলত ভারত থেকে এদেশে চাল আমদানি করা হয়। সম্প্রতি দেশটি থেকেও চাল রপ্তানিতে শুল্ক বেড়েছে। তাছাড়া দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনাও বড় সমস্যা। দেশের ৬১ শতাংশ ধান ও চাল মজুদ করে চালকল মালিকরা। ২০ শতাংশ করে বড় ও মাঝারি কৃষক। বাকি ১৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে কিছু ব্যবসায়ী। ৬১ শতাংশ ধান-চাল মজুদকারীর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাস্তবে চালকল মালিকদের হাতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ। আর তাদের প্রভাব এত বেশি যে সরকারেরও কিছুই করার থাকে না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান জানান, কতিপয় মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ও মজুদদারের কারণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। আগে যাদের হাতে ব্যবসা ছিল, তাদের হাতে এখন নেই। হাতেগোনা কয়েকটি লোকের কাছে ব্যবসা চলে গেছে। এর কারণ ব্যাংকের অসহযোগিতা। কাউকে ব্যাংক ৫০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। কাউকে দিয়েছে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। যাদের কম দিয়েছে তারা বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠছে না। ২০০৯-১৬ পর্যন্ত দেশে চালের দাম বাড়েনি। কারণ তখন ন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ ছিল। সব মিল সচল ছিল। ধীরে ধীরে অর্থায়নের প্রেক্ষাপটে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এখন বেশির ভাগ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আর ওই বন্ধ মিলগুলো ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছে বড় মুনাফাখোর কতিপয় ব্যবসায়ী। মূলত তাদের কারণেই চালের ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি।