খেলারপত্র ডেস্ক:
কবজির মোহনীয় মোচড়, দারুণ ফ্লিক শটে ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে বাউন্ডারি। লফটেড অন ড্রাইভে পরের বলের ঠিকানা ডিপ মিড উইকেট সীমানা। জোড়া চার হজম করে অন সাইডে ফিল্ডার নিলেন মোহর শেখ। ব্যাটসম্যান তা দেখলেন, তবু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। অন সাইডে বড় শটের চেষ্টায় আউট! সৌম্য সরকারের চেনা রূপই ফুটে উঠল ২২ গজে। এক মুহূর্তে তিনি চোখধাঁধানো, পর মুহূর্তেই নিষ্প্রভ। কাছ থেকে সৌম্যর আউট দেখলেন হাবিবুল বাশার। তার অভিব্যক্তি দেখে তখন প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। তবে জাতীয় এই নির্বাচকের কণ্ঠে পরে ঠিকই ফুটে উঠল হতাশা। একসময় যিনি ছিলেন জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেই সৌম্য আপাতত জাতীয় দলের আলোচনাতেই নেই। বিবেচনায় ফিরতে হলে তো রান করতে হবে। কিন্তু সৌম্যর ব্যাটে রান কোথায়! কোনো সংস্করণেই কোথাও তার ব্যাটে হাসি নেই, তার ব্যাটে কথা নেই। ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলি স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে এই ম্যাচটি যেমন। দুই চারে ৯ রান করেই শেষ তার ইনিংস। চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তার নিয়মিত দৃশ্য এটি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ভালো কিছুর আশা জাগিয়ে তিনি অল্পেই থামছেন নিয়মিত। লিগে এবার এখনও পর্যন্ত খেলা ৮ ইনিংস ব্যাট করে তার সংগ্রহ ১৬১। ফিফটি ছুঁয়েছেন স্রেফ এক ম্যাচে।
একসময় সৌম্য ধারাবাহিকভাবে বড় রান না করলেও তার ব্যাটে থাকত আগ্রাসন। তার সেই রূপও এখন উধাও। লিগে তার স্ট্রাইক রেট স্রেফ ৮০.১০! সবশেষ বিপিএলেও সৌম্যর ব্যাট বলা যায় ঘুমিয়েই ছিল। ঢাকা ডমিনেটর্সের হয়ে ১২ ম্যাচে স্রেফ ১৪.৫০ গড়ে করেন ১৭৪ রান। স্ট্রাইক রেট ছিল কেবল ১০৮.০৭! বিপিএল ও প্রিমিয়ার লিগের মাঝে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বিসিবি একাদশের হয়ে এক দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে খেলেন তিনি। সেদিন ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিলেও শেষ পর্যন্ত ৭ চার ও ২ ছয়ে আউট হয়ে যান ৪৬ বলে ৪৮ করে। জাতীয় লিগে এবার একটিই ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। খুলনার বিপক্ষে গত নভেম্বরে সেই ম্যাচে রাজশাহীর বিপক্ষে আউট হয়ে যান ৩৬ রান করে। গত বছর নানা সময়ে বাংলাদেশ টাইগার্সের প্রোগ্রামেও রাখা হয় তাকে। কিন্তু তার পারফরম্যান্সই বলছে, নিজেকে শানিত করতে পারেননি সেখানেও।
সব মিলিয়ে সৌম্যকে নিয়ে হতাশা বাড়ছেই। ব্রাদার্সের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তা অকপটেই বললেন জাতীয় দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশার। “ওর (সৌম্য) কাছে যে প্রত্যাশা ছিল, সেটা ঠিক পাচ্ছি না। কিছু দিন আগেও দলের সঙ্গে ছিল। অতীতে কিন্তু বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতানো অনেক ভালো পারফরম্যান্স আছে সৌম্যর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স পাচ্ছি না।” “সৌম্য এখনও আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে আছে। প্রত্যাশা ছিল ও ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করবে। তাহলে আমাদের যে ক্রিকেটারদের পুল, সেটা বড় হয়। ওর সামর্থ্যরে ব্যাপারে আমরা সবাই জানি। সেটার পুরোপুরি প্রকাশ ঘরোয়া ক্রিকেটে হচ্ছে না। একটু তো হতাশ অবশ্যই।”
সৌম্যর প্রতিভা যা, ছন্দে থাকলে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন, সেই আলোচনা অনেক দিন আগেই আসলে অতীত হয়ে গেছে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তার বড় সমস্যা ছিল ধারাবাহিকতা, যা এখন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এজন্য আপাতত জাতীয় দলের দুয়ার তার জন্য বন্ধ। সবশেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন গত বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ২০২১ সালের মার্চের পর আর খেলেননি কোনো ওয়ানডে। দূরে থাকলেও সৌম্যকে ছুড়ে ফেলা হয়নি বলেই নিশ্চিত করলেন হাবিবুল বাশার। ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙার জন্য সৌম্যর করণীয় সম্পর্কেও বললেন সাবেক এই অধিনায়ক। “ওর সাথে সবাই কথা বলছে। যে সমর্থন দরকার, মানসিক সমর্থনটা, ওকে সবসময় দেওয়া হয়। ও দলের মধ্যে আছে, আসা যাওয়ার মধ্যেই আছে। মাঝে মাঝে এসব থেকে বেরোতে ক্রিকেটারের নিজেরই পথ খুঁজতে হয়। ও কিন্তু অনেক দিন ধরে ক্রিকেট খেলছে। যথেষ্ট অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। মানসিক যে সমর্থন সেটা সে সবসময় পায়। তবে ওর নিজেকেই ঠিক করতে হবে, আসলে ওর খেলাটা কী হবে।”
নিজের খেলোয়াড়ী জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে হাবিবুল বললেন, দুঃসময় থেকে পরিত্রাণের পথটি একটা পর্যায়ে গিয়ে ওই ব্যাটসম্যানকেই খুঁজে নিতে হয়। “একজন ক্রিকেটার হিসেবে আমি মনে করি, সব ব্যাটসম্যানেরই একটা ব্যাটিং পরিকল্পনা থাকে। নিজস্ব ব্যাটিং পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নামে। কোন বোলারকে মারব, কোন বোলারকে ঠেকাব, কোন সাইডে বড়, কোন সাইডে ছোট, বাতাসটা কোন দিকে- এরকম কিছু বেসিক জিনিস আছে। সব ব্যাটসম্যানেরই নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা থাকে। আমার মনে হয়, সৌম্য সরকারের নিজেকে ঠিক করতে হবে, ও আসলে কীভাবে ব্যাটিং পরিকল্পনা করতে চায়।” “অনেক সময় আমরা সহজাত প্রবৃত্তিতে খেলে থাকি। সেটা করলে সবসময় ধারাবাহিক হওয়া যায় না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য। আমি মনে করি সৌম্য অনেক দিন ধরে ক্রিকেট খেলছে, ওকে আসলে বোঝানোর তেমন কিছু নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওর অনেক সাফল্য। বড় বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো ইনিংস আছে। ওকে খুব বেশি বোঝানোর নেই। কিন্তু ওকেই আসলে খুঁজে বের করতে হবে ওর ব্যাটিংটা কেমন হবে।”