নোয়াখালী প্রতিনিধি:
নোয়াখালী শহর নারীদের চলাচলের জন্য অনিরাপদ বলে মনে করেন শহরের ৯৩ শতাংশ মহিলা। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, অফিস, মার্কেট মিলিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত চলাচল করতে হয় নারীদের। শহরে চলাচলের সময় বাস, সিএনজিসহ অন্যান্য যানবাহনে নিজেদের নিরাপদ বোধ করেননা তারা। সম্প্রতি এনজিও সংস্থা প্রাণ(পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক) এর একটি জরিপে শহরে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
গত কয়েক মাসে নোয়াখালীতে নারীর যৌন হয়রানি, শারীরিক আক্রমণ, বেশ কয়েকটি ধর্ষণ সহ ধর্ষণ পরবর্তী খুনের ঘটনা ঘটেছে। বিষয় গুলিকে কেন্দ্র সার্বিক ভাবে এ অঞ্চলের নারীদের চলাফেরার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা কেমন এ বিষয়ের ওপর জরিপ চালিয়েছেন এনজিও সংস্থাটি।
সংস্থাটি তাদের জরিপে তারা তুলে এনেছেন কিভাবে নোয়াখালীতে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। তাদের মাঠ জরিপে অংশগ্রহণকারী শতভাগ নারী ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের ২৫ শতাংশের বয়স ১৫-২৫ বছরের মধ্যে, ৬০ শতাংশ ২১-৩০ বছরের। ১১ শতাংশের বয়স ছিলো ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী বাকিদের সবাই চল্লিশোর্ধ।
পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে জরিপে অংশ নেওয়া নোয়াখালীর ৫৫ শতাংশ নারী মনে করেন এই জেলাতে নারীর প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জরিপের ৮৭.৫ শতাংশ নারী অভিমত দিয়েছেন যে, সহিংসতার বিষয়টি গুরুতর এবং প্রতিকারে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শহরের কোন কোন জায়গাগুলোতে অধিকাংশ নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে সে তথ্য উঠে এসেছে জরিপের। পরিসংখ্যান বলছে শহরের নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন সিএনজি ষ্ট্যান্ডগুলোতে। এছাড়া নোয়াখালী সরকারী কলেজের সামনের রাস্তা নারীদের যৌন হয়রানির অন্যতম স্পট।
জরিপের অধিকাংশ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন শহরের হকার্স মার্কেট মোড়, নোয়াখালী সুপার মার্কেট, মাইজদী বাজার এবং হাউজিং বালুর মাঠ এলাকায়। এছাড়া শহরের হকার্স মার্কেটের ভেতর দিয়ে হেটে যাবার সময় দোকানীদের অমার্জিত অঙ্গভঙ্গি, যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য, ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দবাক্য ছুড়ে দেওয়াকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ নারী।
জরিপে আরও উঠে এসেছে যৌন হয়রানির মতো অপরাধের অন্যতম কারণ। নারীরা মনে করেন যৌন হয়রানি যে একটি অপরাধ সেটিকে অপরাধ হিসেবে চিন্তিত করা হচ্ছেনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্যক্তকারী পুরুষ মনে করেন এটি কোন অপরাধ নয়। অন্যদিকে অনেক নারী যৌন হয়রানির শিকার হবার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করেন। জরিপের ১১.৫ শতাংশ নারীই এমন তথ্য দিয়েছেন।
হাইকোর্টের প্রদত্ত নীতিমালায় ৪টি ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞা রয়েছে। সেই সঙ্গা অনুযায়ী জরিপে অংশ নেওয়া ৪১.৩ শতাংশ নারীকে দেখে শিস বাজানোকে যৌন হয়রানি মনে করেন। এছাড়া পাশ থেকে যাবার সময় অহেতুক হর্ণ দেওয়াকে হয়রানি মনে করেন ৪১.৩ শতাংশ নারী।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৯.২ শতাংশ নারী ঘটে যাওয়া নিপীড়নের কথা পরিবারের সাথে শেয়ার করেনা। আর ৭৭ শতাংশ জানেইনা যে যৌন হয়রানি শিকার হলে সহায়তার জন্য ৯৯৯ এ যোগাযোগ করা যায়।
বুধবার (৩০ নভেম্বর) বিআরডিবি মিলনায়তনে আয়োজিত 'তরুণ প্রজন্মের একতায় গড়বো সমাজ সমতায়' শীর্ষক প্রজন্ম-সংলাপ' অনুষ্ঠানে এসকল বিষয় তুলে ধরে এনজিও সংস্থা প্রাণ। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে প্রচারের অংশ হিসেবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সহায়তায় পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক-প্রান ও একশানএইড বাংলাদেশসহ জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের আয়োজনে ‘প্রজন্ম সংলাপ’ ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এ আয়োজন করা হয়। এসময় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শপথ গ্রহণের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো: শহীদুল ইসলাম। সংলাপে এনআরডিএস, গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট, বন্ধন, নিজেরা করি, ভলেন্টিয়ার ফর বাংলাদেশ, এইচএসবিও, ধ্রুবতারা, প্রথমআলো বন্ধুসভা নোয়াখালী ও রয়েল ইকোনোমিক্স ক্লাবের তরুণ সদস্যরা সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপের শুরুতে পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক-প্রাণের নির্বাহী পরিচালক নুরুল আলম মাসুদ নোয়াখালীতে যৌন হয়রানি বিষয়ক জরিপ তুলে ধরেন।
সংলাপে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের জাতীয় প্রোগ্রাম অফিসার জেফারসন চাকমা, উন্নয়ন সংস্থা এনআরডিএস এর প্রধান নির্বাহী আবদুল আউয়াল, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ফারিয়ান তাহরিম, আফ্রিদা জিননুরাইন উর্বী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি আবু নাছের মঞ্জু, ইউএনএফপিএ এর নোয়াখালীর ফিল্ড অফিসার ডা. সাদিয়া সামরিন হৃদি, ট্রান জেন্ডার অধিকার কর্মী সামসুল ইসলাম পলক, একশনএইডের প্রোগ্রাম অফিসার সাইয়েদা আক্তার, প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।