ডা. সুলতানা রাজিয়া:
পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে। গার্জিয়ানদের মধ্যে ইদানিং বাচ্চাদের অনেক কম বয়সে স্কুলে ভর্তি করার প্রবণতা বেড়েছে। শৈশবের যে বয়সটা থাকে বাচ্চাদের বাধাহীন খেলাধুলা করার, আনন্দ করার, মানুষ ও বিভিন্ন বস্তুর সাথে পরিচিত হবার, সে বয়সটাতেই বাচ্চাদেরকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে, যা শিশুদের স্বাভাবিক জীবনের সঠিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
অতি শৈশব বয়সটা ঠিক পড়াশোনার উপযোগী নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদেরকে এ বয়সেই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে। হয়তো প্রি স্কুল বা প্লে স্কুলে। একটা প্লের বাচ্চার ৭-৮ টা বই থাকে। তাদের হোমওয়ার্ক করতে হয়, নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়, স্কুলের নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। যা একটা প্লে'র বাচ্চার জন্য বোঝা সরূপ।
একটু চিন্তা করে দেখুন, আপনার নিজের ক্ষেত্রেও আপনি আপনার সক্ষমতার বাইরে কতটুকু কাজ করতে পারেন! ধরুন আপনি ৫০ কেজি ওজনের বস্তু বহন করতে পারেন কিন্তু আপনাকে যদি ৭০ কেজি ওজনের কোন বস্তু বহন করতে বলা হয় তবে তা করতে আপনার কতটুকু কষ্ট হবে। ঠিক তেমনি একটি বাচ্চাকে যখন তার খেলাধুলা করার সময় তখন স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় তখন তার মানসিকতা কেমন হয়।
বইয়ের চাপে ব্যাগ এতটাই ভারি থাকে যে, শিশুর পক্ষে তা বহন করা সম্ভব হয় না। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বইয়ের পাশাপাশি সেখানে আরও অনেক বই পড়ানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই বেশি বইয়ের চাপের পরিমাণও বেশি। ব্যাগ বহন করতে হয় বাচ্চার মা কে। শিশুদের পড়াশোনা চাপের জন্য অনেকটাই দায়ী অতিরিক্ত বই। সেখানে এমন ভার বাচ্চার উপর চাপিয়ে দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত যে ভার বাচ্চা বহন করতেই পারে না। অভিভাবকগণ এর মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের সঠিক বিকাশে বাধা প্রদান করে ফেলেন নিজের অজান্তে। যে বয়সটা তাদের খেলাধুলা করে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সে বয়সটাতে তাদের স্কুলে ভর্তি করে তাদের জীবনটাকে রুটিনের মধ্যে আবদ্ধ করে তাদের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসকে সীমাবদ্ধতার গন্ডিতে বন্দী করা হয়।
পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রদান করায় বাচ্চাদের পড়াশোনার প্রতি একটা ভীতি তৈরি হয়। দেখা যায় অনেকে পরীক্ষার সময় অসুস্থতায় ভোগে। জ্বর সর্দি হয়, কারো কারো খিচুনি হয়, আবার অনেকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। দেখা যাচ্ছে খুব একা একা থাকে, কারো সাথে মিশতে চায় না, আবার অনেকে অনেক জেদি বা খিঁটখিটে মেজাজের হয়ে যায়। এ ধরনের সমস্যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এক্সাম ফোবিয়া বা পরীক্ষা ভীতি বলে। এক্সাম ফোবিয়া বাচ্চাদের মানসিক, শারীরিক, নৈতিক ও সামাজিক প্রতিটি বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে ফেলে।
পড়াশোনা একটি মজার ও আনন্দের কাজ। কিন্তু তা বাচ্চাদেরকে বোঝাতে পারা অভিভাবকদের দক্ষতার পরিচয়। অভিভাবকরা যদি বাচ্চাদের কাছে পড়াশোনাকে আনন্দ ও মজার কাজ হিসেবে বোঝাতে সক্ষম হয়, তবে তারা তা আনন্দ ও মজার সাথে করতেই সফল হবে। আপনার সন্তানকে বুঝুন, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান, পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলুন। সে অবশ্যই বুঝতে পারবে। অতিরিক্ত চাপে জীবন আনন্দহীন হয়ে যায়।
শিশুদের অতিরিক্ত পড়ালেখার চাপ দেওয়া থেকে গার্জিয়ান এবং শিক্ষকদের বিরত থাকতে হবে। শিশুদের পড়াশোনাকে করতে হবে বিনোদন নির্ভর, যাতে শিশু আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে। তাহলে পরীক্ষার ফলাফল আপনা আপনিই ভালো হবে।