বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশকে সর্বশেষ যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। ৩ থেকে ৪ জন যুবক তাকে লেগুনায় উঠিয়ে নিয়ে যায় তারাবোর দিকে। ওই লেগুনার চালক ও আরোহীদের খোঁজা হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি জানান, চনপাড়ায় নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে ডিবি।
হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। সাদা পোশাক পরা এক ব্যক্তির সাথে কথা বলে লেগুনায় ওঠে সে। এরপর লেগুনা তারাবো বিশ্বরোডের দিকে চলে যায়। ওই লেগুনায় আরও চার ব্যক্তি ছিলেন।
হারুন বলেন, সাদা পোশাক পরা ব্যক্তি, লেগুনার চালক ও লেগুনায় আগে থেকে থাকা চারজনকে শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সময় ও দূরত্ব বিবেচনায় ওই রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে ফারদিনের চনপাড়ায় যাওয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে ডিবি প্রধান বলেন, ওখান থেকে চনপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলেও রাত আড়াইটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই খুন চনপাড়ায় নয়, অন্য কোথাও হতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা। রহস্য উদঘাটনে ডিবি কাজ করছে বলে জানান তিনি।
যা বলছেন ফারদিনের বাবা :
এদিকে বৃহস্পতিবার ডিবি কার্যালয়ে ছেলে হত্যার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নূর উদ্দিন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার শিকার হয়েছে। আর মামলাটা কী? এসব বলে মামলাটাই পাল্টে দিচ্ছেন। আগাম কথাবার্তা বলা উচিত নয়।’
মামলায় কোনো মোটিভ পাওয়ার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা কিছু জানিয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নূর উদ্দিন রানা বলেন, ‘না, আমাকে সেরকম কিছু জানানো হয়নি। তারা (ডিবি) আমাকে ডেকেছে, ছেলের পড়াশুনা, বয়স, মাদকে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে। সে মুক্তমনা ছিল কি না, যেসব জায়গায় গিয়েছে সেসব জায়গায় অন্য কোনো বন্ধু রয়েছে কি না, এসব বিষয় জানতে চেয়েছে।’
আপনি আগে বলেছিলেন, বাসা থেকে ফারদিনের হলে ফেরার কথা ছিল। হলে যাওয়ার কথা বলেই ফারদিন বের হয়েছিল। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ফারদিন হলে না ফিরে যাত্রাবাড়ীতে গেছে। এর আগে সে এ রকম করেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নুর উদ্দিন রানা বলেন, ‘অতীতে এমন রেকর্ড নেই। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে বা জানিয়ে সব করে সে। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে তার মাকে যা জানিয়েছে, সে অনুযায়ী চলতে দেখেছি। কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছি না সে আসলে কেন গিয়েছিল যাত্রাবাড়ীতে।’
মাদকের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদকে জড়ানোর বিষয়ে ডিবি কিছুই বলেনি আমাকে। মাদকের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়নি, সেটা ডিবি পুলিশ ক্লিয়ার করেছে। আমিও এর আগে বলেছি। আমার ছেলে কখনো ধূমপান করত না। এমনকি ধোঁয়াও সহ্য করতে পারত না।’
বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোনো স্ট্রেস বা অবসাদে ভুগছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, সে রকম কিছু নয়। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। বিদেশ যাওয়া হলো না বলে ভেঙে পড়ার মতো ছেলে সে নয়। ওর চরিত্রের মধ্যে সেরকম কিছু নেই। হত্যার বিষয়ে ডিবি পুলিশ ও র্যাব জোর দিয়ে তদন্ত করছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার পর। যেহেতু সাসপেক্ট করা হচ্ছে। পরিকল্পিত কি না সেটা বের করতে হলে সময় লাগতে পারে। সব বিষয়ে আমরা তো অনুমান করতে পারি না।’
আপনি মামলার বাদী, ছেলে হারিয়েছেন কিন্তু তদন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চিত করেছেন ফারদিন হত্যায় বান্ধবী বুশরা জড়িত নয়। বুশরার জন্য আপনার খারাপ লাগা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বুশরার জন্য প্রচণ্ড রকমের খারাপ লাগা তো আছেই। কিন্তু বুশরার সঙ্গে ফারদিনের ৫/৬ ঘণ্টা কাটানোর কথা নয়। এই মেয়ে এতটা সময় কাটানোর কথা নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না বুশরা জড়িত নয়।’
র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফারদিন হত্যায় জড়িতদের প্রায় খুঁজে বের করা হয়েছে। নজরদারিতে আছে। র্যাবের দাবি, চনপাড়ার রায়হান গ্যাং ও তার সহযোগীরা মিলে ফারদিনকে হত্যা করেছে। রায়হান ও সহযোগীদের আটক করা হয়েছে বলে খবরও বেরিয়েছে। র্যাব কি আপনাকে ডেকে এসব ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? আপনি কী মনে করেন, ফারদিন চনপাড়ায় হত্যার শিকার হয়েছে?
এসব প্রশ্নের জবাবে বাবা নূরউদ্দিন বলেন, ‘র্যাব থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে মামলা দায়েরের পর থেকে তারা কোনো আপডেট দেয়নি। এই যে ম্যাসেজটা দিলো, কারা দিলো, কোন সংস্থা দিলো তা আপনারা জানেন। বিচারাধীন বিষয়ে এমন তথ্য দেওয়াটা কতটা যথাযথ? ওখানে যে ফুটেজ দেখানো হলো, রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলেটার কী বিরোধ থাকবে?’
র্যাবের দাবি :
এদিকে র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হান গ্যাং ফারদিন হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গল ও বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশপাশে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হতে পারে। আমরা অনেকটাই নিশ্চিত যে চনপাড়ার রায়হান গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এখানে। রায়হানকে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি তাহলে ফারদিন খুনের মোটিভ বের করতে পারব। তবে ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল সে কারণটা এখনো বের করতে পারেনি র্যাব।
তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। মরদেহ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মরদেহ উদ্ধারের দুই দিন পর ১০ নভেম্বর ফারদিনের বান্ধবী ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আমাতুল্লাহ বুশরাসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা।
এ মামলায় বুশরাকে গ্রেপ্তার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। রিমান্ডে বুশরার কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে বা আদৌ কোনো তথ্য পাওয়া গেছে কি না তা এখনো জানায়নি ডিবি।