Date: December 22, 2024

দৈনিক বজ্রশক্তি

Header
collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / লক্ষ্যভ্রষ্ট উম্মতে মোহাম্মদী

লক্ষ্যভ্রষ্ট উম্মতে মোহাম্মদী

November 23, 2022 04:13:02 PM   বিশেষ নিবন্ধ

ইলা ইয়াছমিন:
যেকোন সৃষ্টির প্রারম্ভে একটি বিরাট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। লক্ষ্যহীন প্রতিটি সৃষ্টি বা আবিষ্কার বৃথা। মহান আল্লাহও উদ্দেশ্য ছাড়া একটি ধূলিকণাও সৃষ্টি করেননি। স্রষ্টার তৈরি প্রতিটি সৃষ্টির মহৎ কোন লক্ষ্য থাকে। যেমন স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। যেন পৃথিবীতে তাঁরা মানব রচিত অন্যসব জীবনবিধান প্রত্যাখান করে আল্লাহর দেয়া হুকুমবিধান দিয়ে তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করতে পার। তবেই তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। আল্লাহ পৃথিবীতে যে শেষ জীবনব্যবস্থা দিয়ে রাসুলুল্লাহকে (সা.) পাঠিয়েছেন সেটার লক্ষ্যও ছিল সমগ্র পৃথিবীতের ইবলিসের বিধান অকার্যকর করে আল্লাহর হুকুম, বিধান, আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ।
পৃথিবীতে উদ্যেশ্যহীন বা আকিদাহীন কোন কিছুই নেই। উদ্দেশ্য যদি ভুল হয়, তাহলে কোন কিছুরই দাম থাকে না। হোক সেটা নগণ্য বিষয় ও মহা গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। মনে করুন, দশজন লোক একটা উদ্দেশ্য নিয়ে রওনা হলো। অর্ধেক পথ গিয়ে যদি দশজনের উদ্দেশ্য ভুলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে কি হবে? একেকজন একেকদিকে চলে যাবে । শেষ গন্তব্যস্থলে কেউই পৌঁছাতে পারবে না। এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার নামই হলো আকিদা বা সম্যক ধারণা। এজন্য  ইসলামে প্রায় সকল আলেমগণ একমত আকিদা ভুল হলে ঈমানের কোন দাম নেই, ঈমান ছাড়া আমলেরও কোন মূল্য নেই। এটা যেমন একটি বস্তু হতে পারে বা বিষয়ও হতে পারে।
ঠিক যেমন আজ যদি কোনো কমিউনিস্টকে প্রশ্ন করা যায় যে, তোমরা পৃথিবীময় যে এত সংগ্রাম করছো, বহু কোরবানী করে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছ, কেন করছো? ঐ কমিউনিস্ট অবশ্যই জবাব দিবে, পৃথিবীতে যে সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে সেটার পরিণাম যেহেতু অর্থনৈতিক অবিচার, শোষণ, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট কাজেই সেটাকে ভেঙ্গে কমিউনিজম চালু করলে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন হবে ফলে মানুষ মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে, খেয়ে-পরে বাঁচবে। মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য পৃথিবীময় কমিউনিস্টরা নিজেদের সব কিছু উৎসর্গ করে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
একই কারণে, বিপুল সংগ্রামের মাধ্যমে মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্যও উম্মতে মোহাম্মদীরাও পার্থিব সবকিছু ত্যাগ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্টদের সাথে ইসলামের বিরাট তফাৎ রয়েছে। প্রথমত এটি শুধুমাত্র একটি দিকের নিশ্চয়তা দেয় তাহলো ‘অর্থনীতি’ এবং কমিউনিস্টরা যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করে তা  সম্পূর্ণটাই মানুষের তৈরি ব্যবস্থা যা প্রতিষ্ঠা করলে পরিপূর্ণ শান্তি আসবে না। এর প্রমাণ ইতিহাস। কমিউনিজমের পতন হয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ হলো।
কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁর সাহাবারা (রা.) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিজেদের বলিদান দিয়েছেন সেটা ছিল স্বয়ং আল্লাহর তৈরি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা। যা শুধু অর্থনৈতিক সঙ্কট নয় বরং মানবজীবনের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আধ্যাত্মিক সকল সঙ্কট দূর করতে সক্ষম। আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা দেহ আত্মার সংমিশ্রণ। আল্লাহ বলেন, "এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী বা ভারসাম্যযুক্ত জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছি (সূরা বাকারা: ১৪৩)। এই ভারসাম্যযুক্ত জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতির সকল অঙ্গণে শান্তি, ইসলাম আনয়ন করাই হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদীর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যেটা আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম।
রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর একজীবনে সর্বাত্মক ও বহুমুখী সংগ্রামের মাধ্যমে সমগ্র আরব উপদ্বীপে এই শেষ জীবনবিধান কায়েম ও কার্যকর করলেন। কিন্তু ইসলাম আগমণের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র পৃথিবীময় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এত বিশাল কাজ কোনো মানুষের এক জীবনে সমাপ্ত করা অসম্ভব। তাই তিনি প্রকৃতিগতভাবেই এমন একটি উম্মাহ গঠন করলেন যাদের লক্ষ্যস্থির করে দিলেন সমগ্র দুনিয়ায় দীনুল ইসলামের পতাকা ওড়ানো। এই উম্মাহর নাম দিলেন উম্মতে মোহাম্মদী।  
আজকে সারা পৃথিবীতে ১৬০ কোটি মুসলিম দাবীদ্বার যারা আছেন তারা নিজেদের উম্মতে মোহাম্মদী বলেও বিশ্বাস করেন; কিন্তু তারা জানেন না উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে তাদের কি দায়িত্ব। কেন উম্মতে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল? তাদের বিশ্বাস নামায, রোজা, হজ¦, যাকাতের মধ্যেই ইসলামের সীমাবদ্ধতা। তারা ভুলে গেছেন তাদের উত্থান হয়েছিল পৃথিবীময় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করার জন্য। সেটা পালন না করে এই জাতি সর্বময় পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা অর্থাৎ দাজ্জালের দেওয়া বিভিন্ন মতবাদ, জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়েছে। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি মানার পাশাপাশি তারা নামায, রোজাও পালন করছে। যেটা স্পষ্টত শেরক এবং যে গোনাহের কোন ক্ষমা নেই।
হাশরের দিন আল্লাহর রসুল (সা.) সবার আগে হাউসে কাউসারে পানি পান করতে যাবেন। তখন একদল মানুষ আসবে যারা হাউসে কাউসারের পানি পান করতে চাইবে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাদের মধ্যকার এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবন্ধকতার কারণ জানতে চাইবেন- মালায়েকরা বলবে, “আপনি জানেন না, হে আল্লাহর রসুল (সা.) আপনার পর এই উম্মতেরা কি কি সংযোজন-বিয়োজন করেছে। এই কথা শুনে বিশ্বনবী (সা.) বলবেন, “দূর হও! দূর হও! যারা আমার পর দীনে বে’দাত করেছো”। 
রসুলের (সা.) মাধ্যমে আল্লাহ যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে পাঠিয়েছেন তা পরিপূর্ণ ও নিখুঁত। তাতে কোন কিছু নতুন সংযোজন বা বিয়োজন করাই ছিল বে’দাত। এই বে’দাতকে মহানবী (সা.) শেরক বলেছেন, যা আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না। কারণ, এটা করা মানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা এবং প্রকারান্তরে এটা স্বীকার করা যে আল্লাহর দীন পূর্ণ নয়। এই জাতি আল্লাহর দীনের মধ্যে শুধু যে সংযোজন-বিয়োজন করেছে তা নয় বরং দীনের সর্বপ্রধান অর্থাৎ জাতীয় ভাগটিকে বর্জন করে সেখানে পাশ্চাত্যের তৈরি ব্যবস্থা, তন্ত্র-মন্ত্র গ্রহণ ও প্রয়োগ করেছে। আর ধর্ম পালনের জন্য রসুলের (সা.) একান্ত ব্যক্তিগত সুন্নাহগুলো পালন করছে এবং এসব করছে পুরো নিষ্ঠার সাথে যেন মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের জান্নাতে দাখিল করা হবে। যারা প্রকৃত লক্ষ্য ত্যাগ করে নিজেদের উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে আছে তারা উভয় জগতেই ব্যর্থ। যা দুনিয়ার জীবনে ভোগ করছে সেটাই পরকালে অপেক্ষা করছে।