সাদ্দাম হোসেন:
সারাদেশে এসএসসি পরিক্ষা চলমান। এর মাঝেই ফরিদপুরের সালথায় শুরু হয়েছে হযরত শাহ সুফি মওলানা খাজা মদন হাজী আল কাদরি আল চিশতি (র:) এর ১৩৭ তম ওরশ শরীফ। ওরস শরীফকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর হাজী বাড়ির আঙ্গিনায় তিনদিন ব্যাপী চলে জমজমাট মেলা। তবে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে এ বছর চলছে অশ্লীল নৃত্যের রমরমা ব্যবসা। শুক্রবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে চলেছে গভীর রাত পর্যন্ত। পাশাপাশি থেমে থেমে চলে মাদক ও জুয়া। অশ্লীল নৃত্য নিয়ে স্থানীয় ও আগত ভক্তবৃন্দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহ সুফি মওলানা খাজা মদন হাজী আল কাদরি আল চিশতি (র:) একজন কামিল ও আল্লাহ ওয়ালা লোক ছিলেন। তার আধ্যাতিক জ্ঞান চারিদকে ছড়িয়ে পড়লে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক আসতে থাকে। ভক্তদের কথা চিন্তা করে হযরত শাহ সুফি খাজা মদন হাজী বছরের মাঘী পূর্নিমাতে একটানা তিনদিন ওরশের ঘেষণা দেন। এসময় বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তরা এখানে আসে, জিকির-আইজকার, মিলাদ-কিয়াম ও ওয়াজ নছিহত সহ বিভিন্ন ধর্মীয় হুকুম আহকাম পালন করেন। ভক্তদের আগমনে হাজী বাড়ির মাঠে বসে বিশাল মেলা।
হযরত শাহ সুফি মওলানা খাজা মদন হাজী আল কাদরি আল চিশতি (র:) এর মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মেলায় খাদ্য সামগ্রি থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর আসবাবপত্র, কসমেটিক সহ নানা রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তবে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে মেলা কমিটি এবছর পুতুল নাচ বা ভূতের ঘরের শো নামে এক অশ্লীল নৃত্যের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে ৫০/১০০ টাকা নিয়ে আধা ঘন্টা থেকে ১ঘন্টা ব্যাপী শো চলে। বিভিন্ন শো এর ফাঁকে ফাঁকে যুবতীদের দিয়ে করানো হয় অশ্লীল নৃত্য। উচ্চ শব্দে চলা এই নৃত্য দেখতে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই ভীড় করে।
খোলা মেলা পোশাক আর অশ্লীল অঙ্গ ভঙ্গির এই শো তে কাউকে মোবাইলে ছবি বা ভিডিও করতে দেওয়া হয় না। উচ্চ শব্দে মেলার মাইক চালানোর কারনে এসএসসি পরিক্ষার্থীসহ স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই আবার গোপনে শো দেখতে ভীড় করছে। মেলার আশপাশে থেমে থেমে চলে জুয়া ও মাদকের আসর। পুলিশ আসলে সাময়িক বন্ধ থাকলেও পুলিশ গেলে আবার চলে। মেলার খরচ দেখিয়ে দোকানিদের থেকে স্টল ভেদে নেওয়া হচ্ছে টাকা। তাছাড়া লাইটিং এর জন্য বাতি প্রতি নেওয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। টাকার পরিমান কম হলেই দোকানীদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়।
স্থানীয় বয়স্ক লোক আবুল বাসার মোল্যা জানান, হযরত শাহ সুফি খাজা মদন হাজী একজন কামিল পীর। অতীতে এই মেলায় এমন অশ্লীল কাজকর্ম করার সাহস কেউ করে নাই। এই অশ্লীলতার জন্য হাজী বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। উচ্চ শব্দে মাইক চালানোর কারনে শব্দ দূষন হচ্ছে। এই পুতুল নাচের কারনে আমাদের উঠতি বয়সের সন্তানেরা অশ্লীলতা ও ইভটিজিং এর মত নষ্টামির দিকে ধাবিত হবে। তাছাড়া জুয়া ও মাদকের কারনে যুবসমাজ নষ্ট হচ্ছে। তারা ছোটখাটো আরও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমি এসব অশ্লীলতা সহ ওরশ শরীফ ঘিরে সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধের আহবান জানাই।
হযরত শাহ সুফি মওলানা খাজা মদন হাজী আল কাদরি আল চিশতি (র:) এর বংশধর শাহ কামাল উদ্দিন বলেন, আমরা থানা সহ সবজায়গাতেই বলেছি, ওরশ উপলক্ষে কোন অশ্লীল নৃত্য বা বেআইনি কাজ চলবে না। যদি কেউ মাদক বা জুয়ায় জড়িয়ে পরে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমি সবাইকে অনুরোধ জানাই। মেলা খাজনা বাবদ কিছু খরচ নেওয়া হয়। খরচ মিটিয়ে আমরা কিছু অর্থ নেই।
মাঝারদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আফছার মাতুব্বর বলেন, মেলার আশপাশের স্থানীয় লোকজন বেশি ভাল না। তাই আমরা ঐ মেলা বাজারে যাই না। তবে মেলায় অনেক কিছুই হচ্ছে, আমি জানতে পরেছি। আমি চাই সকল খারাপ কাজ বন্ধ হোক।
স্থানীয় ইউপি সদস্য উপজেলা কৃষকলীগ নেতা নুরআলম মাতুব্বর বলেন, মেলা ঘিরে জুয়া ও মাদকের ছড়াছড়ি। তাছাড়া টিন দিয়ে ঘিরে মেলা যে অশ্লীল নৃত্য তা মেনে নেওয়া যায় না। আমি মাননীয় ডিসি স্যার, এসপি স্যার আমাদের ইউএনও স্যসময় স্যার, ওসি স্যার ও স্থানীয় সাংবাদিক সমাজ সহ সংশ্লিষ্ট সবাই এই সকল বেআইনি কাজ বন্ধে এলাকাবাসির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাই।
মেলা আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য রাজু আহমেদ উজ্জল বলেন, অশ্লীল নৃত্যের বিষয়ে আমি কিছু জানি না, তবে গতকাল মেলার পাশে জুয়ার আসর বসলে আমি দাবড়িয়ে দেই। মেলা অশ্লীল কাজসহ যেকোন বেআইনি কাজের বিপক্ষে আমি আছি। আয়োজক কমিটির আরেক সদস্য পি সদস্য কবির মোল্যা বলেন, মেলায় কোন অশ্লীল নৃত্য হয় না, এমনি জাদু দেখানো হয়। যদি কেউ ভুল করে থাকে তাহলে তা বন্ধ করা হবে। তারপরেও যদি চলে তাহলে পুলিশ প্রশাসন ও আমাদের জানাবেন।
সালথা থানা চার্জ অফিসার এসআই মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা খবর পাওয়া মাত্রই নৃত্য বন্ধ করা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে সালথা থানা পুলিশের টিম পোশাকে ও সাদা পোশাকে দায়িত্বরত আছে। যেকোনো বেআইনি কাজ বন্ধে আমরা বদ্ধ পরিকর।
সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আনিছুর রহমান বালী বলেন, তাদেরকে জেলা প্রশাসক থেকে অনুমতি সাপেক্ষে মেলা আয়োজন করতে পারবে মর্মে জানানো হয়েছে। অনুমতি না থাকলে মেলা বন্ধ করে দেয়া হবে। মেলায় অশ্লীল বা বেআইনী কোন কিছু হলে আয়োজনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।