ইসরায়েলের-হামাসের চলমান যুদ্ধের শুরুর দিকে হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া মুসলিমদের বৃহত্তম সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্ত এলাকায় রকেট ও গোলা নিক্ষেপ শুরু করেছে লেবাননভিত্তিক এই গোষ্ঠী, পাল্টা বোমা হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল তার জবাবও দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে লেবাননভিত্তিক এই গোষ্ঠীর উপপ্রধান নাঈম কাসিম জানিয়েছেন, এখনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহ ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, তবে ‘সময় এলে’ এই যুদ্ধে হামাসের পক্ষে সরাসরি যুক্ত হবেন তারাও।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা, হিজবুল্লাহ হয়তো ইরান ও তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশে হামাসকে সহযোগিতা করার জন্য ইতোমধ্যেই একটি নতুন ফ্রন্ট তৈরি করে ফেলেছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা,যদি সত্যিই হিজবুল্লা কোনো নতুন ফ্রন্ট গঠন করে—সেক্ষেত্রে তার ভবিষ্যৎ ফলাফল হামাস ও গাজা উপত্যকার বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বস্তিকর হবে। তবে লেবাননেনের জন্য তা হবে রীতিমতো ‘বিধ্বংসী’ এবং ইসরায়েলের জন্য ‘বিপর্যয়কর’।
যা বলছে অতীত রেকর্ড
ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ বাঁধে ২০০৬ সালে। ওই বছর জুলাই মাসে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত থেকে দুই ইসরায়েলি সেনা সদস্যকে অপহরণ করে হিজবুল্লাহ। এই অপহরণের জবাবে এই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।
৩৪ দিন স্থায়ী হওয়া সেই যুদ্ধে জয়ী হয়নি কোনো পক্ষই; তবে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা রেডক্রস অ্যান্ড রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, এই সময়সীমার মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় লেবাননে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি লেবানিজ এবং ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার বাড়িঘর, ১০৯টি সেতু এবং ৭৮টি হাসাপাতাল।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের হিজবুল্লাহ বিশেষজ্ঞ নিকোলাস ব্ল্যানফোর্ড আল জাজিরাকে জানাান, ওই যুদ্ধের সময় সময় ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার যোদ্ধা, এবং সেই অনুপাতে গোলাবারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র ও স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সম্বল ছিল হিজবুল্লাহ বাহিনীর।
‘তবে গত ১৭ বছরে হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে,’ আলজাজিরাকে বলেছেন ব্ল্যানফোর্ড।
কতখানি শক্তিশালী হিজবুল্লাহ
আল জাজিরাকে ব্ল্যানফোর্ড বলেন, তার কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে নিয়মিত ও রিজার্ভ মিলিয়ে হিজবুল্লাহ বাহিনীতে যোদ্ধা রয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার। এছাড়া গোষ্ঠীটির মজুতে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ২০০৬ সালে মাত্র ১৪ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল হিজবুল্লাহর।
এসব ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই স্বল্প পাল্লার, তবে সেগুলো লেবানন থেকে ইসরায়েলের যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো শক্তিশালী। তাছাড়া ইরানের তৈরি মাঝারি পাল্লার প্রিসিশন গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে হিজবুল্লাহর, যেগুলোর গড় রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার।
‘বর্তমানে যে পরিমাণ সামরিক সক্ষমতা রয়েছে হিজবুল্লাহর, তা ইসরায়েলের গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি সাধনের জন্য যথেষ্ট। সম্ভবত এ কারণেই গত কয়েক বছর ধরে হিজবুল্লাহকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করছে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা,’ বলেন ব্ল্যানফোর্ড।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অপর থিংক ট্যাংক সংস্থা মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজোল্যুশন বিভাগের পরিচালক রান্ডা স্লিম জানান, অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ ও যোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের গোয়েন্দা তৎপরতারও ব্যাপক উন্নতি করেছে হিজবুল্লাহ।
আলজাজিরাকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তারা সিরিয়ার দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাদের। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা নিজেদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কেরও ব্যাপক উন্নতি করেছে।’
ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কা কতখানি
রান্ডা স্লিমের মতে, ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত এলকায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনরি সঙ্গে হিজবুল্লাহর ছোটখাটো সংঘাত এখন নিয়মিত ব্যাপার, তবে বর্তমানে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের জেরে মধ্যপ্রাচ্যের যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি— তাতে যে কোনো সময় দু’পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত বেঁধে যেতে পারে।
এবং যদি সেই সংঘাত বাঁধে— সেক্ষেত্রে তার প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে ইরান। রান্ডা স্লিম বলেন, ‘ইরান গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ন্যাটোর অনুকরণে নিজের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিরোধী পক্ষ তৈরির চেষ্টা করছে; অর্থাৎ এই পক্ষের কোনো একটি দেশ বা শক্তি যদি আক্রান্ত হয়— সেক্ষেত্রে পক্ষের অন্যান্য সদস্যরাও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
‘বর্তমানে এই প্রতিরোধী পক্ষ তৈরি কাজ অনেকখানি এগিয়েও গেছে। এই পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী প্লেয়ার হিজবুল্লাহ।’
তবে শিগগিরই ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর সংঘাত বাঁধার সম্ভাবনা দেখছেন না নিকোলাস ব্ল্যানফোর্ড। মার্কিন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, মার্কিন ও ইসরায়েলি বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা থেকে ইরানকে রক্ষা করা এখন হিজবুল্লাহর মনযোগের কেন্দ্রে রয়েছে।
‘অর্থাৎ হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ এখন সম্পূর্ণভাবে ইরানের হাতে। ইরান যতক্ষণ ইশারা না দেয়, ততক্ষণ হিজবুল্লাহ এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করবে না।’