করোনাভাইরাস নির্মূল করতে কঠোর ‘জিরো কোভিড নীতি’ নিয়েছে চীন; কিন্তু এই নীতির প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাবস্থাপনাগত নানা দুর্বলতা এবং গুজবের প্রভাবে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কোভিডকর্মীদের সঙ্গে সংঘাত-বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে জনগণের।
সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ ও দেশটির অন্যতম শিল্প এলাকা গুয়াংজুর বিভিন্ন শহরে পুলিশ ও কোভিডকর্মীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব শহর থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজগুলোয় দেখা গেছে, স্থানীয় জনগণ পুলিশের টহল যানবাহন উল্টে দেওয়ার পাশাপাশি কোভিড ব্যারিকেড ভাঙচুর করছেন।
দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইন বিধি জারি থাকা সত্ত্বেও গুয়াংজু প্রদেশে সম্প্রতি বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা। প্রদেশের হেইঝু শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিল্পাঞ্চল হওয়ায় গুয়াংঝুর শহরগুলোতে বসবাসকারী জনসংখ্যার অধিকাংশই শ্রমিক।
তাদের অভিযোগ, একদিকে লকডাউনের কারণে দিনের পর দিন ধরে বন্ধ থাকছে প্রদেশের বিভিন্ন কল-কারখানা— অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে কোনো অর্থ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে না। সেইসঙ্গে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
এসব কারণে গুয়াংজুবাসীর মধ্যে করোনা লকডাউন ভাঙ্গার প্রবণতা অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, পুলিশ এবং কোভিড কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের বাক-বিতণ্ডাও চলছিল।
কিন্তু সোমবার মধ্যরাতের দিকে প্রদেশটির বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে লকডাউনবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় পুলিশ ও কোভিডকর্মীদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতিও হয়।
গুয়াংঝু প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকার থেকে গণ করোনা টেস্টের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফার আশায় জনগণকে ভুয়া পিসিআর রিপোর্ট সরবরাহ করছে’— এমন একটি গুজব সম্প্রতি চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে জিরো কোভিড নীতির কারণে ব্যাপক চাপে থাকা চীনের সাধারণ জনগণ রীতিমতো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন।
দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় হেবেই প্রদেশেও বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। প্রদেশের কোনো শহরের ওষুধের দোকানে করোনার সঙ্গে সম্পর্কিত ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানতে পেরেছে, সম্প্রতি হেবেই প্রদেশে গণ করোনা টেস্ট বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রাদেশিক সরকার। তারপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে করোনা নিয়ে নতুন গবেষণা শুরু করেছে সরকার এবং এই গবেষণায় হেবেই প্রদেশের জনগণকে ‘গিনিপিগ’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘গবেষণার’ অংশ হিসেবে করোনার কোনো ওষুধ আর হেবেই প্রদেশে আসবেনা বলেও গুজব ছড়ানো হয়। তারপরই করোনার ওষুধ কিনতে ফার্মেসিগুলোতে জনগণের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে বর্তমানে হেবেইয়ের কোনো শহরের ফার্মেসিতে আর করোনার ওষুধ নেই।
এদিকে জিরো কোভিড নীতি থাকার কারণে চীনের অনেক দপ্তর-কার্যালয়-কোম্পানি কর্মীদের জন্য প্রতিদিন করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক করে নোটিশ জারি করেছে। সেই নোটিশে বলা হয়েছে, কার্যালয়ে প্রবেশের সময় নিরাপত্তারক্ষীকে অবশ্যই করোনা টেস্টের রিপোর্ট প্রদর্শন করতে হবে। যদি কোনো কর্মী সেই রিপোর্ট প্রদর্শনে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে তাকে দপ্তরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এতদিন এই শর্ত মানতে তেমন অসুবিধায় পড়তে হয়নি রাজধানী বেইজিংয়ের কর্মীদের; কারণ বেইজিংয়ে বিভিন্ন সড়ক ও অফিসের সামনে ভ্রাম্যমান করোনা টেস্ট কেন্দ্র ছিল।
কিন্তু বেইজিংয়ের স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি রাস্তা ও অফিসের সামনের অধিকাংশ ভ্রাম্যমান করোনা টেস্ট কেন্দ্র উঠিয়ে দেওয়ায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ কর্মীরা। তাদেরকে করোনা টেস্টের জন্য আবাসিক ভবনের সামনে স্থাপিত কেন্দ্রগুলোতে যেতে হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একাধিক ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, বেইজিংয়ের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার করোনা টেস্ট কেন্দ্রগুলোর সামনে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছেন মানুষজন।