ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়া সফরে গেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সেখানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকে ওয়াং বলেছেন, নেতৃস্থানীয় বৈশ্বিক শক্তি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে বিশ্বে স্থিতিশীলতা রক্ষায় চীন-রাশিয়ার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সামরিকীকরণ নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে চীন ও রাশিয়া একে অপরের আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতিতেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কোতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
আল জাজিরা বলছে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দুই দেশের মধ্যে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ এবং ‘বহুমুখী বিশ্ব’ ও ‘আরও ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার’ প্রতি উভয় দেশের অভিন্ন প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করে সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে তার আলোচনার সূচনা করেন।
ওয়াং বলেন, নেতৃস্থানীয় বৈশ্বিক শক্তি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে বিশ্বব্যাপী কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক উন্নয়ন বজায় রাখতে চীন ও রাশিয়ার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সোমবার রাশিয়ায় চারদিনের সফর শুরু করেন। আগামী মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠকের আগে এই সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া রাশিয়া সফরের আগে ওয়াং মাল্টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সাথে বৈঠক করেন। মূলত বাণিজ্য থেকে শুরু করে তাইওয়ানে চীনা সামরিক হুমকি পর্যন্ত নানা ইস্যুতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
চীনের শীর্ষ এই কূটনীতিক আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাশিয়ায় থাকবেন এবং সেখানে রুশ কর্মকর্তাদের সাথে কৌশলগত নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনার পরিকল্পনা করছেন বলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।
এদিকে উভয় নেতার বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ‘বৈশ্বিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রক্রিয়াগুলোতে স্বার্থের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে রাশিয়ান-চীনা সহযোগিতার গুরুত্বের ওপর’ জোর দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, রাশিয়া এবং চীন এই সপ্তাহের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের প্রচেষ্টার সমন্বয় করবে।
অন্যদিকে বৈঠকে ওয়াং জোর দিয়ে বলেছেন, ‘রাশিয়া-চীন সহযোগিতা ‘কারও বিরুদ্ধে পরিচালিত নয় এবং অন্য কোনও দেশের মাধ্যমে প্রভাবিতও নয়’।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইতোপূর্বে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে শুরু হওয়া রুশ আগ্রাসনের নিন্দা না করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে বেইজিং।
চীন এই সংঘাতে কোনও পক্ষ বেছে নেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। বেইজিং একদিকে বলছে, একটি দেশের ভূখণ্ডকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে, অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোকে সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিষয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ বিবেচনা করতে হবে বলেও মন্তব্য করছে।
এছাড়া ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে চলমান যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছে চীন। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে ইউক্রেনকে।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য উভয় দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কমানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওয়াং এবং সুলিভানের মধ্যে আলোচনাকে ‘খোলামেলা, মৌলিক এবং গঠনমূলক’ হিসাবে উল্লেখ করেছে বেইজিং ও ওয়াশিংটন। মাল্টায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকটি ১২ ঘণ্টা ধরে চলেছিল।
ওই বৈঠকে আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান প্রণালীর মতো ইস্যু ছিল। আর সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এবং চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যান ঝেং-এর মধ্যে একই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
হ্যান ঝেং-এর সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, ‘বিশ্ব আশা করে, আমরা দায়িত্বের সাথে আমাদের সম্পর্ক পরিচালনা করব। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক সেটাই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আল জাজিরা বলছে, মাল্টায় অনুষ্ঠিত ওয়াং এবং সুলিভানের মধ্যে আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল চলতি বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠকের ভিত্তি স্থাপন করা। যদিও সেই বৈঠকের পরই রাশিয়া সফরে গেছেন ওয়াং ই।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের চীন বিশেষজ্ঞ রায়ান হাস বলেছেন, ‘আমি আশা করি, উভয় পক্ষই আগামী নভেম্বরে উভয় নেতার মধ্যে একটি ফলপ্রসূ বৈঠকের মঞ্চ তৈরি করতে কাজ করছে।’