ভারতে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঢাকা সফর করবেন। গত তিন দশকে বাংলাদেশে কোনও ফরাসি প্রেসিডেন্টের এটিই হবে প্রথম সফর।
এর আগে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ ১৯৯০ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ফরাসি দূতাবাস জানায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের কৌশল বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যাবেন। এই সফর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে চলা একটি দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার এবং দেশটির আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ দেবে।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বিশেষ করে প্যারিস এজেন্ডা ফর পিপল অ্যান্ড দ্য প্ল্যানেট সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে বাংলাদেশও। জলবায়ু সংকটের কারণে বাংলাদেশ যে ক্রমবর্ধমান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সেটি কাটিয়ে উঠতে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ঢাকাকে সহায়তার বিষয়ে সফরের সময় ফ্রান্সের প্রতিশ্রুতি পুনর্নিশ্চিত করবেন।
দূতাবাসের ওই বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় এবং জাতিসংঘের অধীনে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ফরাসি দূতাবাস বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের বিষয়েও টুইট করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের অগ্রাধিকারমূলক ইস্যুগুলোর একটি। বাংলাদেশে এটি এএফডি ফ্রন্সের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যারা গত ৫ বছরে এই খাতে বার্ষিক প্রতিশ্রুতি প্রায় তিনগুণ বাড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আসন্ন সফর এই প্রতিশ্রুতিতে নতুন গতিশীলতা আনবে।’
ফরাসি দূতাবাসের এই টুইট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিসের প্রতিশ্রুতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। একইসঙ্গে এখানে এএফডির ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সর্বোপরি এটি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আসন্ন সফরের সময় সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা গুরুত্বপূর্ণ এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন।
ফ্রান্স বর্তমানে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে এবং এই অঞ্চলের ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্স-বাংলাদেশ সম্পর্ক যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তিন বিলিয়ন ইউরোর বেশিতে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে ঢাকায় নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে ফ্রান্সে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এছাড়া চলতি বছরের জুলাইয়ের শুরুতে ফরাসি নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চট্টগ্রামে শুভেচ্ছা সফর করে এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। এসময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুয়ের একটি বিবৃতি দেন। মূলত এসবের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের বৃহত্তর অঞ্চলে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বকেও স্বীকার করে নেয় ফ্রান্স।
ফ্রান্সের নতুন মিত্র দরকার
বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে, কারণ পশ্চিম ইউরোপের এই দেশটি নতুন জোট গড়তে চায়। আফ্রিকার দেশগুলোতে ইতোপূর্বে ফরাসি উপনিবেশ বা মিত্র বলে পরিচিত দেশগুলোতে ফ্রান্সের প্রভাব হ্রাস পাওয়ায় এই প্রয়োজনীয়তা আরও অনুভব করছে দেশটি।
এছাড়া নাইজার ও গ্যাবনের মতো দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান এবং পরে সেখানে ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ দেশটিকে চিন্তায় ফেলেছে। সর্বশেষ গ্যাবনের অভ্যুত্থান ছিল গত তিন বছরের মধ্যে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলোতে অষ্টম সামরিক অভ্যুত্থান।
ক্রমবর্ধমান ফরাসি বিরোধী মনোভাবের কারণেই একের পর এক অভ্যুত্থান হয়েছে। আর অভ্যুত্থানের পর এসব দেশগুলোতে রাশিয়া আগ্রহের সাথে তার উপস্থিতি বাড়িয়েছে এবং তার নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থের জন্য দেশগুলোকে ব্যবহার করেছে। এছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি অসন্তোষ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কারণ পূর্ব-পশ্চিম ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগে থেকেই বিদ্যমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেক দেশ আবার নিজেদেরকে কোনও একটি পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করছে। কোন পক্ষে অবস্থান নিতে হবে তা নির্ধারণ করা বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে তুলনামূলকভাবে সোজা। কারণ রাশিয়া এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যারা আফ্রিকায় কখনও উপনিবেশ স্থাপন করেনি। এছাড়া স্নায়ুযুদ্ধের যুগে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিল রাশিয়া। যা অনেক আফ্রিকান দেশ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিল।
চলতি বছরের এপ্রিলে ফরাসি প্রেসিডেন্টের চারটি আফ্রিকান দেশ সফরের সময় স্থানীয় ফ্রান্সের দূতাবাসের বাইরে ফরাসি ঔপনিবেশিকতার নিন্দা করে আয়োজিত বিক্ষোভের মাধ্যমে ম্যাক্রোঁকে ‘স্বাগত জানানো’ হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্টের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, কারণ এটি তাকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ দেবে। মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তার বিবেচনার বাইরেও ফ্রান্স বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় ফ্রান্সের উপস্থিতি এবং প্রভাব বাড়ানোর সমন্বিত প্রচেষ্টা রয়েছে দেশটির। বঙ্গোপসাগর বরাবর বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ইন্দো-প্যাসিফিকে ফ্রান্সের কৌশলগত উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীদার হিসেবে ঢাকার তাৎপর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং এর প্রায় তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর হতে চলেছে।
ফলে এই সফরের সময় অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূলত বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ঘিরে উদ্বেগের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-সহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো ব্যবস্থা নিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপকে বাংলাদেশে এই ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানির প্রসঙ্গ
এছাড়া বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমান সরকারের হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে চলমান হয়রানি ও তাদের আটকের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা। গত আগস্ট মাসে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি পাঠান। চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম ও হয়রানি অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানানো হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, ড. ইউনূস ফ্রান্সের সাথে বেশ জোরালো ও দৃঢ় সংযোগ বজায় রেখেছেন। ২০১১ সালে যখন এই নোবেল বিজয়ীকে গ্রামীণ ব্যাংকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়, তখন ফ্রান্স গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তৎকালীণ ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি সেসময় ড. ইউনূসের প্রতি লিখিতভাবে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন।
ড. ইউনূস যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন সেগুলো স্বীকার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত সমাধানে পৌঁছাবে বলেও সেসময় আশাপ্রকাশ করেছিলেন সারকোজি। এমনকি তিনি পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং আগামী দিনে এই বিষয়টি মোকাবিলায় বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সাথে যুক্ত থাকার বিষয়ে ফ্রান্স সরকারের প্রতিশ্রুতিও জানিয়েছিলেন।
সুতরাং ভারতে জি-টোয়েন্টি সম্মেলন শেষে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যখন বাংলাদেশে আসবেন তখন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সম্পর্কিত আলোচনা আসন্ন বৈঠকে কথোপকথনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে এবং এটি মোটামুটি স্পষ্ট।
এছাড়া এটিও অনুমান করা যেতে পারে, ড. ইউনূস যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, সেগুলোর ন্যায্য সমাধান অর্জনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করবেন বর্তমান এই ফরাসি প্রেসিডেন্ট।
আর তাই ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্ক জোরদার করতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তার মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলা এবং বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পথ চলার ক্ষেত্রে কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।
এছাড়া এই সফরটি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথিত হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগও দূর করবে। সামগ্রিকভাবে এই সফরের ফলাফল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক গতিশীলতাকে নতুন রূপ দেবে।
সূত্র: মডার্ন ডিপ্লোমেসি