লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা:
লক্ষ্মীপুরে পৃথক তিনটি হত্যা মামলারয় রায় দিয়েছেন আদালত। এরমধ্যে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যায় একজনের মৃত্যুদণ্ড ও অপরজনের যাবজ্জীবন প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে আরেকটি হত্যা মামলায় ২৫ বছর পর দুইজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং স্ত্রী ও তার পরকীয় প্রেমিককে হত্যার দায়ে এক ব্যক্তিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত।
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যয় দুইজনের যাবজ্জীবন: লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে জবিউল হক মাস্টার নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার ১৪ বছর পর দুই আসামিকে সাজা দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে আসামি মো. জুয়েলের (৩৮) মৃত্যুদণ্ড এবং মাহবুব ওরফে মাফুকে (৩৭) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। এসময় আরও চার আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। গতকাল বুধবার দুপুরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১ এর বিচারক আজিজুল হক এ রায় দেন। রায়ের সময় আসামিরা আদালতে অনুপস্থিত ছিলেন। দণ্ডপ্রাপ্ত জুয়েল রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার ইউনিয়নের সেবাগ্রামের ফারুক হাওলাদারের ছেলে এবং মাহবুব মৃত মানিক হাওলাদারের ছেলে। ভিকটিম মুক্তিযোদ্ধা জবিউল হক একই এলাকার হাজী আবদুল কাদেরের ছেলে।
আদালতের এপিপি মো. আবুল কালাম রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলার এজাহার এবং আদালত সূত্রে জানা গেছে, জমি থেকে মাটি কাটার জেরে ২০০৯ সালের ২৩ জুন বেলা ১১টার দিকে প্রতিবেশী আবদুর রশিদের ছেলে আলাউদ্দিন চৌধুরীর (৫৪) নির্দেশে অভিযুক্তরা মুক্তিযোদ্ধা জবিউল হকের মাথায় কাঠ দিয়ে আঘাত করেন। এতে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় ভিকটিম জবিউল হকের ভাই হাজী নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে আলাউদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনের নামে রামগতি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১১ সালের ২১ মে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দেন লক্ষ্মীপুর সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক বশির আহাম্মদ।
অভিযোগপত্রে তিনি মামলার প্রধান আসামি আলাউদ্দিনসহ আবদুল্লাহ, মাহবুব, স্বপন, জুয়েল ও মাকসুদ হাওলাদারকে অভিযুক্ত করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মামলার ৫ নম্বর আসামি জুয়েলের মৃত্যুদণ্ড এবং ৩ নম্বর আসামি মাহবুব ওরফে মাফুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে মামলার প্রধান আসামি ও চার্জশিটভুক্ত আলাউদ্দিন, আবদুল্লাহ, স্বপন ও মাকছুদ হাওলাদারকে খালাস দেওয়া হয়। এদিকে রায়ের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী নুরুল ইসলাম। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ঘটনার নির্দেশদাতা ও মামলার প্রধান আসামি আলাউদ্দিন খালাস পেয়েছে। আমরা তার খালাসের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।
হত্যার ২৫ বছর পর দুইজনের যাবজ্জীবন: লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে মোশাররফ হোসেন নামে এক তহসিলদারকে কুপিয়ে হত্যার ২৫ বছর পর মো. ইদ্রিস কালা ও চৌধুরী বরকত নামে দুইজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে এক বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত ইদ্রিস রামগতির চর সেকান্তর গ্রামের আবদুল গোফরানের ছেলে ও বরকত একই গ্রামের এবাদ উল্যার ছেলে। এ ছাড়া মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস সাত আসামিকে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রায়ের সময় দণ্ডপ্রাপ্তরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার এজাহার ও আদালত সূত্র জানায়, জমি নিয়ে চর সেকান্তর গ্রামের বাসিন্দা মৃত দ্বারা বক্স মাঝির দুই ছেলে আবদুল গোফরান ও মোশাররফ হোসেন তহসিলদারের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
এর জেরে ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই সকালে আবদুল গোফরান ও তার ছেলে ইদ্রিসসহ অন্য ছেলেরা মোশাররফকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় একইদিন মোশাররফ তহসিলদারের ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী বাদী হয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে রামগতি থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন রামগতি থানার এসআই সালাহ উদ্দিন আল মাহমুদ। দীর্ঘ শুনানি শেষ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত দুই আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করলেন।
পরকীয়া প্রেমিকসহ স্ত্রীকে হত্যায় আমৃত্যু কারাদণ্ড: অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে পরকীয়া প্রেমিক ইউসুফ ও স্ত্রী রিনা বেগমকে হত্যার দায়ে ইব্রাহিম খলিল (৪০) নামে এক ব্যক্তির আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তার ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। দণ্ডপ্রাপ্ত ইব্রাহিম রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। পেশায় তিনি ইটভাটার কর্মী ছিলেন। লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রিনা ও তার পরকীয়া প্রেমিক ইউসুফ অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। বাড়িতে এসে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে ইব্রাহিম তাদের হত্যা করে। আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এতে আদালত তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিনে গিয়ে ইব্রাহিম পলাতক আছেন। মামলা সূত্রে জানা যায়, ইব্রাহিম ফেনীর একটি ইটভাটার কর্মী ছিলেন। রামগতি চরলক্ষ্মী গ্রামের বেলাল মাঝির ছেলে ইউসুফ ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এতে প্রায়ই ইউসুফ তার বাড়িতে যেতেন। একপর্যায়ে ইব্রাহিমের স্ত্রী রিনার সঙ্গে ইউসুফের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
২০১৭ সালের ৩ জুন ইফতারের সময় ইউসুফ ওই বাড়িতে যান। ফেনী থেকে ইব্রাহিম বাড়িতে এসে রিনা ও ইউসুফকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ইব্রাহিম দুজনকেই ঘরে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। খবর পেয়ে তছলিমা বেগম স্বামী ইউসুফকে উদ্ধার করে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পথে মারা যান। পরদিন তছলিমা বাদী হয়ে রামগতি থানায় মামলা করেন। এছাড়া আহত অবস্থায় রিনাকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৬ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। নোয়াখালীর সুধারাম থানায় নিহতের মা জানু বেগম একটি জিডি করেন। এদিকে হত্যা দুটি একই ঘটনা হওয়ায় ১১ জুন মামলাটি রামগতি থানার মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার ইব্রাহিমকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। একই বছরের ১২ নভেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও রামগতি থানার এসআই ফরিদ আহম্মদ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।