আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লার নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলের বোম হামলায় নিহত হবার পর প্রতিশোধ স্বরূপ ইসরায়েলের তেলআবিব, জেরুজালেমসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে দুই দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে দেশটির প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ইরান। প্রায় ২ শ’ ক্ষেপনাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে ইসরাইলে।
এদিকে ইরানকে এই হামলার ‘ফল ভোগ করতে হবে’ বলে ইসরায়েল জবাব দেওয়ার যে হুমকি দিয়েছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে বড় যুদ্ধের শঙ্কা আরও গভীর হচ্ছে। এরই মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
কয়েকশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চল কেঁপে উঠেছে বলে খবর এলেও হতাহতের কোনো তথ্য দেয়নি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো, যাদের সর্বশেষ খবরে বলা হচ্ছে, রাতের মত আঘাত করা স্থগিত করেছে তেহরান।
মঙ্গলবার রাত ৮টার পর ইরানের বিপ্লবী রক্ষাবাহিনী-আইআরজিসি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নির্দেশে এই হামলা চালায় বলে ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে।
রেডিও তেহরান বলছে, চার শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে আইআরজিসি, যার মধ্যে অত্যাধুনিক শ্রেণির অস্ত্রও রয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে আইআরজিসি বলেছে, এই প্রথম ইসরায়েলে তারা হাইপারসনিক শ্রেণির ‘ফাতাহ’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হেনেছে।
হামলার আগেই ইসরায়েলকে এমন সতর্কবার্তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যাতে বলা হয়েছিল, যে কোনো মুহূর্তে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করতে পারে তেহরান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সে বার্তাই সত্য হল।
আর এই হামলার মধ্য দিয়ে নড়ে উঠল জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতি। বুধবারই এই বিষয়ে আলোচনায় বসছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। মার্কিন আইনপ্রণেতারাও এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলের আকাশে তেহরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যে কোনো প্রয়োজনে দেশটির পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে ওয়াশিংটন।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য হার্টৎজ লিখেছে, হামলার সতর্কতা হিসেবে সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েলিরা ক্ষেপণাস্ত্রনিরোধী বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়, অন্যরা রাস্তায়, দোকানে যে যেখানে ছিল সেখানেই মাটিতে বা মেঝেতে শুয়ে পড়ে। টেলিভশন স্টেশনে ইসরায়েলি সাংবাদিকদের মেঝেতে শুয়ে পড়তে দেখা যায়, যার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে হার্টৎজ।
আইআরজিসি চার শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার কথা বললেও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে হার্টৎজ লিখেছে, ইরান থেকে ১৮০টির মত ক্ষেপণাস্ত্র এসেছে, যার বেশিরভাগই ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
রেডিও তেহরান বলেছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে বৃষ্টির মত ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানছে ক্ষেপণাস্ত্র।
পুরো ইসরাইল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় এসেছে এবং দেশটির রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
আইআরজিসি বলেছে, আত্মরক্ষার তাগিদে তারা এই হামলা চালিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরপরই আইআরজিসি এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলে ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু’।
আইআরজিসি পরিষ্কার করে বলেছে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এবং আইআরজিসির ডেপুটি কমান্ডার আব্বাস নিলফোরুশানের শাহাদাতের বদলা নিতে ইসরায়েলে এই হামলা চালানো হয়েছে।
“আমরা অধিকৃত ভূখণ্ডের হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছি,” বিবৃতিতে বলেছে বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী।
সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তারা বলেছে, ইসরাইল যদি কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করে, তাহলে আরও মারাত্মক হামলা চালানো হবে।
জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশন বলেছে, এই হামলা বৈধ, যৌক্তিক এবং এর আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ইসরাইলের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর খবর পেয়ে রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন শহরের রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ এবং তারা উল্লাস প্রকাশ করে, লিখেছে রেডিও তেহরান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন। বাইডেন ইসরাইল অভিমুখী ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার জন্য মার্কিন সেনাদের নির্দেশ দেন।
ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইলের সমস্ত বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। জর্ডান ও ইরাকের বিমানবন্দরেও বিমান ওঠানামা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়।
নাসরাল্লাহ হত্যার পরপরই লেবাননে ইসরায়েল সীমিত আকারে স্থল অভিযান শুরু করার পর ইরান থেকে হামলা হল।
বিবিসি ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু ছবি প্রকাশ করে বলেছে, তেল আবিবের আকাশে এই ক্ষেপণাস্ত্র দেখা গেছে।
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, দুই দফা হামলার প্রথম দফায় তেল আবিব এবং দ্বিতীয় দফায় জেরুজামেলকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় তেহরান।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে এক ইউরোপীয় সাংবাদিক বলেন, সেখানে এক ঘণ্টায় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কমলা রঙের উজ্জ্বল কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র দেখা গেছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি দেশটির টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বলেন, “ইরান ‘মারাত্মক আঘাত’ হেনেছে। আমরা এ বিষয়ে দেশকে সর্বদা প্রস্তুত রাখব। অবশ্যই ইরানকে এর ফল ভোগ করতে হবে।”
মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধের দামামা এখনই বন্ধের আহ্বান রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্ত্যোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই সংঘাত এখনই বন্ধ করা দরকার, অবশ্যই এখন একটি যুদ্ধবিরতি খুবই প্রয়োজন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি বলেছেন, কোনো ধরনের পাল্টা হামলা বা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হলে তেহরান তার কড়া জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ‘ইরানের হামলা’ পরাহত হয়েছে বলে দাবি করে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার কথা বলেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
এ সময় তিনি লেবাননে যুদ্ধবিরতির কথা বলেন, যাতে করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে সুরাহার পথ সুগম হয়।