টানা তাপপ্রবাহ ও তার ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ দাবানলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ৩ দেশ আলজেরিয়া, ইতালি এবং গ্রিসে ৪০ জনেরও বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত প্রায় এক সপ্তাহ আগে সৃষ্ট এই দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে ৩ দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে আলজেরিয়ায়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যগুলোর তথ্য অনুসারে, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বেজাইয়ায় মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনেরও বেশি মানুষের। এই মৃতদের মধ্যে ১০ জন সেনাসদস্যও রয়েছেন।
গত কয়েকদিনের দাবানলে বেজায়া ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই প্রদেশটি এর আগে কখনও এত বিস্তৃত- ভয়াবহ দাবানল দেখেনি। আগুন নেভানো এবং উপদ্রুত এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনতে দেশটির সরকার দমকল বিভাগের কর্মীদের পাশাপাশি সেনা সদস্যদেরও নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে দাবানলের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, তবে এখনও আগুন নেভানোর কাজ করে যাচ্ছে আলজেরীয় সরকারের বিশাল বাহিনী। সেই বাহিনীতে রয়েছেন প্রায় ৮ হাজার কর্মী, শত শত অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র এবং কয়েকটি বিমান।
ভূমধ্যসাগরীয় অপর দেশ এবং আলজেরিয়ার প্রতিবেশী তিনিউনিসিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। দেশটির উপকূলীয় গ্রাম মেল্লোউলা থেকে ৩০০ মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে দুর্যোগ মোকাবিলা বিভাগের কর্মীরা। তবে এখন পর্যন্ত তিউনিসিয়ায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সাগরপাড়ের অপর দেশ গ্রিসের বিভিন্ন দ্বীপে প্রতি মুহূর্তে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে দাবানল। তার প্রধান কারণ টানা তাপপ্রবাহ ও তার জেরে দেশটির প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছগুলোর শুকিয়ে প্রায় কাঠে পরিণত হওয়া। গ্রিসের দাবানালপিড়ীত এলাকাগুলোতে তাপামাত্রা সর্বোচ্চ ৪৪ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। বেসামারিক সুরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয় বুধবার গ্রিসের ১৩টি অঞ্চলে ‘চরম বিপদসংকেত’ জারি করেছে।
রাজধানী এথেন্সের নিকটবর্তী এভিয়া দ্বীপে আগুন নেভাতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুই বিমানচালক। এছাড়া দ্বীপটির একটি প্রত্যন্ত গ্রামের পুড়ে যাওয়া কুঁড়েঘর থকে এক ব্যক্তির দগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
দাবানলের শিকার গ্রিসের অপর দ্বীপ রোডসের বাড়িঘর ও ট্যুরিস্ট রিসোর্টগুলো থেকে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে এনেছেন দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা। রোডসের বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই লোকজনের মধ্যে একটি বড় অংশই পর্যটক এবং গত রোববার থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে ৪০টিরও বেশি জরুরি ফ্লাইটে চেপে রোডস ছেড়েছেন অন্তত ৫ হাজার পর্যটক। একই ঘটনা ঘটেছে করফু এবং ক্রিট দ্বীপেও।
গ্রিসের অর্থনীতির একটি শক্তিশালী খাত পর্যটন। দেশটিতে প্রতি ৫টি চাকরির একটি পর্যটনসংক্রান্ত। কিন্তু দাবানলের কারণে চলতি মৌসুমের পর্যটন খাতে রীতিমতো ধস নেমেছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই নাগরিকদের গ্রিস ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছে।
এদিকে,ভূমধ্যসাগরীয় অপর দেশ ইতালি দাবানলের পাশাপাশি নাকাল হচ্ছে ঝড়, টর্নেডো ও শিলাবৃষ্টিতেও। একদিকে গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে টানা তাপপ্রবাহ-দাবানলে পুড়ছে ইতালির মধ্য ও অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে ঝড়-টর্নেডোর মতো দুর্যোগ।
ইতালির সিসিলি দ্বীপে ৭০ বছর বয়সী এক দম্পতি এবং ৮৮ বছর বয়সী এক নারী দাবানলের সময় ঘর থেকে বের হতে না পেরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
তাপপ্রবাহের কারণে বৈদ্যুতিক তার গলে যাওয়ায় বিদ্যুৎ ও পানিবিহীন হয়ে পড়েছেন দ্বীপটির কাতানিয়া শহরে বাসিন্দারা। সোমবার শহরের তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ইতালির মূলভূমি কালাব্রিয়ায় নিজ ঘরে পুড়ে মারা গেছেন ৯৮ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তার কন্যা ও জামাতাও আহত হয়েছেন।
দাবানলের কারণে ইতোমধ্যে সিসিলি, পুগলিয়া, ফগিয়াসহ দেশটির বিভিন্ন দ্বীপ থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে।
ইতালির বেসামরিক সুরক্ষামন্ত্রী নেল্লো মুসুমেকি বিবিসিকে বলেন, ‘ইতালির এক অংশ দাবানলে পুড়ছে, অপর অংশে নিয়মিত হচ্ছে ঝড়-টর্নেডো। গত কয়েক দশকের মধ্যে এমন জটিল আবহাওয়াগত বিপর্যয় আমরা দেখিনি।’