পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতির মামলায় আদালতের তিন বছরের কারাদণ্ডের ঘোষণার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশটির জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীর। তিনি বলেছেন, এই মামলার রায় অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে বিচারক রায় ঘোষণার জন্য আজকের সকালের অপেক্ষায় ছিলেন!
তিনি বলেন, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের বিরুদ্ধে তোশাখানা মামলাটি অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ট্রায়াল কোর্ট ও অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ হুমায়ুন দিলাওয়ার যেভাবে মামলাটি পরিচালনা করেছেন তা অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করবে।
শনিবার (৫ আগস্ট) ইসলামাবাদের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত ইমরান খানকে তোশাখানা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের সাজা ঘোষণার পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ইমরান খানকে দেশটির সক্রিয় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছে আদালত।
দেশটির রাজধানীর জেলা ও দায়রা আদালত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় উপহার তছরুপের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করেছে। যদিও শুরু থেকে ইমরান খান তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ৭০ বছর বয়সী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিদেশ সফরের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে পাওয়া এসব উপহার সামগ্রীর মূল্য ১৪০ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির বেশি।
মামলার গ্রহণযোগ্যতা বাতিল চেয়ে ইমরান খানের করা আবেদন খারিজ করে দিয়ে শনিবার ইসলামাবাদের অতিরিক্ত ও দায়রা আদালতের বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
তোশাখানা মামলার রায়ের বিষয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের সঙ্গে আলাপকালে হামিদ মীর বলেছেন, ‘আজকের রায় অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রত্যেক পাকিস্তানি জানতেন যে, এই রায় হবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘ইমরান খান ও তার আইনজীবীরা মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে বিচারক রায় আগেই লিখে রেখেছিলেন এবং আজ সকালে ঘোষণা করার অপেক্ষায় ছিলেন।’
‘আপাতদৃষ্টিতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ওজন বহন করে। তবে আদালত যেভাবে মামলাটি পরিচালনা করেছে এবং এই বিষয়ে বিচারক যে আচরণ করেছেন, তা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ।’
হামিদ মীর বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে এবং ইমরান খানের পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই দেশের আরেকজন প্রধানমন্ত্রী সাজা পেয়েছেন।
‘কেবল প্রধানমন্ত্রীরা শাস্তি পান এবং যারা সংবিধানকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেন, তারা মুক্ত হয়ে চলে যান,’ বলেন তিনি।
• বড় সিদ্ধান্ত
দেশটির আরেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনসার আব্বাসি এই রায়কে একটি ‘বড় সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, তোশাখানা মামলাটি মেগা দুর্নীতিগুলোর একটি হোক বা না হোক, আপনি যখন নওয়াজ শরিফকে সুপ্রিম কোর্টের অযোগ্য ঘোষণার দিকে তাকান, তখন ধরে নিতে হবে এই মামলাটিও শক্তিশালী ছিল।
আনসার আব্বাসি বলেন, ইমরান খান ও তার আইনজীবীরা এই সত্য সম্পর্কে জানতেন। এই কারণে তারা মামলার কৌশলগত বিভিন্ন বিষয়ের দিকে নজর দিয়েছিলেন এবং শুনানি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।
‘এটা শক্তিশালী একটি মামলা ছিল। কারণ সব সংসদ সদস্যকে প্রতি বছর প্রকাশ্যে সম্পদের ঘোষণা দিতে হয়... যদি সেই ঘোষণায় কোনও বিচ্যুতি ধরা পড়ে, তাহলে তা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ইমরান খান প্রথমে তার সম্পদের ঘোষণা দেননি। বরং গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়ার ২ বছর পর নিজের সম্পদের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
দেশটির এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ইমরান খান একটি সুবিধাও পেয়েছেন। কারণ মামলাটির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়নি। একটি নিম্ন আদালতে শুনানি হয়েছে। এর ফলে তিনি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন।
• দুর্ভাগ্যজনক
মামলা রায়ের বিষয়ে দেশটির জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক শাহজাইব খানজাদা বলেছেন, এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, আরেকজন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
তোশাখানা মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রায় খুব তাড়াতাড়ি ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ এই মামলার কিছু পিটিশন এখনও ইসলামাবাদ হাইকোর্টে রয়েছে; যেগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি।
শাহজাইব খানজাদা বলেন, পিটিশনগুলোর মধ্যে কয়েকটির শুনানি আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে পিটিআই চেয়ারম্যানের জমা দেওয়া সাক্ষী তালিকা বিচারক দিলাওয়ারের খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা একটি পিটিশনও রয়েছে। যদি ইসলামাবাদ হাইকোর্ট বিচারককে সাক্ষীর বক্তব্য বিবেচনা করা উচিত বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, তাহলে বিচার আবার শুরু হবে। তবে এখন যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, কীভাবে তা কার্যকর হবে সেটি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
• তোশাখানা মামলার আদ্যোপান্ত
গত বছরের ২১ অক্টোবর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী সম্পর্কে ‘মিথ্যা বিবৃতি ও ভুল ঘোষণা’ দিয়েছিলেন বলে জানায়। একই সঙ্গে দেশটির সংবিধানের ৬৩(১)(পি) অনুচ্ছেদের অধীনে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে।
পরবর্তীতে দেশটির নির্বাচনী এই পর্যবেক্ষক সংস্থা রাজধানী ইসলামাবাদের একটি দায়রা আদালতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই সময় পিটিআই প্রধানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার আবেদনে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সম্পর্কে ইমরান খান ইসিপিকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
এরপর ট্রায়াল কোর্ট গত ১০ মে পিটিআই চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করে এবং মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা বাতিল চেয়ে ইমরান খানের করা আবেদন খারিজ করে দেয়।
ইসলামাবাদের হাইকোর্ট গত ৪ জুলাই ট্রায়াল কোর্টের রায় বাতিল এবং আবেদনকারীকে পুনরায় শুনানিতে অংশগ্রহণ ও সাত দিনের মধ্যে এই মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
৮ জুলাই দায়রা আদালতের অতিরিক্ত বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে তোশাখানা মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে ইমরান খানের আইনজীবীরা এই মামলার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আবারও ইসলামাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেন।
বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন ইমরান খানের আইনজীবীরা তার ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও এনেছিলেন এবং মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর চেয়েছিলেন।
২ আগস্ট ট্রায়াল কোর্ট পিটিআই চেয়ারম্যানের জমা দেওয়া মামলার সাক্ষীদের তালিকা খারিজ করে জানায়, ইমরান খান তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রমে সাক্ষীদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে ইমরানের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ট্রায়াল কোর্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা হয়।
পরবর্তীতে পিটিআই চেয়ারম্যান আবার হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চেয়ে মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তরের আবেদন করেন।
গত ৪ আগস্ট ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমির ফারুক নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ দাখিলের এখতিয়ার ও এতে পদ্ধতিগত কোনও ত্রুটি হয়েছে কি না তা পুনঃপরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টিকে ট্রায়াল কোর্টে ফেরত পাঠান।
প্রধান বিচারপতি ইমরান খানের দায়ের করা চারটি পিটিশন— বিচারব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগ, মামলা স্থানান্তর এবং বিচারকের বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেন।
শনিবার বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার যখন এই মামলার শুনানি পুনরায় শুরু করেন, তখন পিটিআই চেয়ারম্যানের কোনও প্রতিনিধি তার সামনে উপস্থিত ছিলেন না। এরপর আদালত একাধিকবার শুনানি মুলতবি করে এবং ইমরানের আইনজীবী দলের কেউ হাজির না হওয়ায় রায় সংরক্ষণ করেন।
পরে বিচারক রায় ঘোষণা করে বলেন, পিটিআই প্রধানকে দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।