লাখ লাখ আফগান শরণার্থী এবং অভিবাসীদের উচ্ছেদ করার বিষয়ে পাকিস্তানের পরিকল্পনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে দাবি করেছে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান।
এছাড়া পাকিস্তানের নিরাপত্তা সমস্যার জন্য আফগানিস্তানের নাগরিকরা দায়ী বলে যে অভিযোগ ইসলামাবাদ করেছে, সেটিও অস্বীকার করেছে তারা। বুধবার (৪ অক্টোবর) রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
এর আগে অবৈধভাবে প্রবেশ করা ১৭ লাখ ৩০ হাজার আফগান অভিবাসীকে আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দেয় পরমাণু শক্তিধর এই দেশটির সরকার। গত মঙ্গলবার দেশটির তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার উল হক কাকার এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তত্ত্বাবধায়ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি।
সংবাদ সম্মেলনে বুগতি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে কোনও দেশ বা তার নীতির চাইতে পাকিস্তানের নাগরিকদের নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে এই প্রথম আমরা এমন কোনও আদেশ দিচ্ছি।’
সেসময় তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে সব অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। ১ নভেম্বরের পর থেকে অভিযানে নামবে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। সে সময় যদি কোনও অবৈধ অনুপ্রবেশাকারী ধরা পড়েন, তাহলে তাদেরকে জোর করে নিজেদের দেশে পাঠানো হবে।’
পরে বুধবার অভিবাসীদের উচ্ছেদ করার বিষয়ে পাকিস্তানের এই পরিকল্পনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে দাবি করে তালেবান। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে কাবুলে তালেবান প্রশাসনের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বুধবার বলেন, ‘আফগান শরণার্থীদের প্রতি পাকিস্তানের আচরণ অগ্রহণযোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আফগান শরণার্থীরা পাকিস্তানের নিরাপত্তা সমস্যায় জড়িত নয়। যতক্ষণ না তারা স্বেচ্ছায় পাকিস্তান ত্যাগ করবে, ততক্ষণ পাকিস্তানের উচিত তাদের বসবাসের সুযোগ দেওয়া।’
জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ১০ লাখ আফগান নাগরিক পাকিস্তানে শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধিত আছেন এবং আরও ৮ লাখ ৮০ হাজার আফগান নাগরিকের দেশটিতে অবস্থান করার আইনি বৈধতা রয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গত মঙ্গলবার বলেছে, আরও ১৭ লাখ ৩০ হাজার আফগান নাগরিক পাকিস্তানে কোনও ধরনের আইনি বৈধতা ছাড়াই বসবাস করছে এবং তাদের দেশত্যাগ বা বহিষ্কারের মুখে পড়ার জন্য আগামী ১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মানবাধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আফগান শরণার্থীদের প্রতি ‘ঐতিহাসিক সমর্থন’ অব্যাহত রাখতে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, ‘তারা অবিশ্বাস্যভাবে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। এখন তাদের হয় পাকিস্তানে শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধনের জন্য কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে; অথবা অন্য দেশে আশ্রয় পাওয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে থাকতে হবে। এসব শরণার্থীকে আফগানিস্তানে জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তন তাদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।’
এছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনকে (ইউএনএইচসিআর) পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা চাওয়া আফগানদের আবেদনের নিবন্ধন ও পর্যালোচনা ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পাকিস্তানকে শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ‘ক্র্যাকডাউন’ বন্ধ করতেও বলেছে অ্যামনেস্টি।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে বসবাসরত আফগান শরণার্থীদের একটি অংশ পাকিস্তানে এসেছিলেন ১৯৭৯ সালে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর। তারপর ১৯৯৫-৯৬ সালে তালেবান সরকার প্রথমবারের মতো ক্ষমতা দখলের পর শরণার্থী হিসেবে আসেন আরও কয়েক লাখ শরণার্থী।
এই শরণার্থীদের অধিকাংশই থাকেন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তানে। দেশটিতে বর্তমানে অনিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছেন ১৭ লাখের বেশি, যাদের কাছে কোনও বৈধ কাগজপত্র নেই। এই শরণার্থীদেরই ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তান।
এছাড়া চলতি বছর পাকিস্তানে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দেশটির থিংকট্যাংক সংস্থা পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৭১টি আত্মঘাতী, বোমা ও বন্দুক হামলা ঘটেছে।
এসব হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮৯ জন, আহত হয়েছেন আরও ৬৫৬ জন। পাকিস্তানে সর্বশেষ বড় আকারের জঙ্গি হামলা হয়েছে ঈদে মিলাদুন্নবির দিন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বেলুচিস্তানের মাসটাং শহরে ঈদে মিলাদুন্নবির মিছিলে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়, সেই হামলায় নিহত হন অন্তত ৫২ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক মানুষ।
পাকিস্তানের নিষিদ্ধঘোণিত তালেবানপন্থি দল তেহরিক-ই তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) বিরুদ্ধে এসব হামলা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। দেশটির পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব হামলার ক্ষেত্রে ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নিবন্ধনবিহীন আফগান শরণার্থীদের।