কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ক্ষোভ, উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কানাডার মুসলিমরা। তারা বলছেন, এই ঘটনায় মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, এমনকি উদ্বেগও রয়েছে যে, বর্তমানে তারা নিরাপদ নয়।
এছাড়া কানাডার মুসলিম এবং শিখ সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে একে অপরকে সমর্থন করে এসেছে বলেও জোর দিয়ে বলছেন তারা। মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
এর আগে গত সপ্তাহে কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সেসময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা শিখ নেতা নিজ্জারের হত্যার সাথে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে।
কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের একটি শিখ মন্দিরের বাইরে গত ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করা হয় ৪৫ বছর বয়সী হরদীপ সিং নিজ্জারকে। হাউস অব কমন্সের সভায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেন, কানাডার মাটিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যার পেছনে ভারতীয় এজেন্টরা জড়িত থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করার মতো ‘বিশ্বাসযোগ্য কারণ’ রয়েছে।
আল জাজিরা বলছে, শিখ নেতা হত্যায় ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সামনে আসার পর কানাডার অনেক মুসলিম ও সমর্থক আইনজীবীরা দেশটির সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য আরও ভালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছেন।
অ্যাডভোকেসি গ্রুপের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস (এনসিসিএম)-এর প্রধান স্টিফেন ব্রাউন আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ভারত সরকারের এজেন্টরা কানাডায় কাজ করছে এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করছে, এটা সবাই জানে।’
তিনি বলেন, ‘তবে প্রকাশ্য দিবালোকে উপাসনাস্থলের বাইরে কাউকে হত্যা করার মতো ঘটনাটি আসলে একটি বার্তা পাঠানোর উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়েছে।’
ব্রাউন বলছেন, কানাডিয়ান মুসলমানরা চায়, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ট্রুডো সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। তার ভাষায়, ‘আমি বলব তাদের (মুসলিমদের) মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, প্রকৃত উদ্বেগও রয়েছে যে, বর্তমানে তারা নিরাপদ নয়।’
ভারত অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এছাড়া ভারত ২০২০ সালে নিজ্জারকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসাবে ঘোষণা করে এবং নিজ্জারকে হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর আনা অভিযোগটিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে নয়াদিল্লি।
অবশ্য ভারতের বিরুদ্ধে ট্রুডোর এই অভিযোগ সামনে আসার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ট্রুডোর এই অভিযোগ ভারত ও কানাডার মধ্যে কুৎসিত কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে, যদিও এই দুটি দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভালো বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে।
উত্তেজনার একপর্যায়ে উভয় দেশ একে অপরের একজন করে কূটনীতিককে বহিষ্কার করে এবং গত বৃহস্পতিবার থেকে কানাডিয়ান নাগরিকদের জন্য ভিসা পরিষেবা স্থগিত করে ভারত। এছাড়া কানাডা ভারতে তার কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে এনেছে এবং বলেছে, কানাডিয়ান কিছু কূটনীতিক সোশ্যাল মিডিয়ায় হুমকি পেয়েছেন।
যদিও কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে, তারপরও ব্রাউন বলছেন, ভারত সরকার কানাডায় নিজ্জার বা শিখ অ্যাক্টিভিজমকে যেভাবেই দেখুক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিহত শিখ নেতাকে কানাডার নাগরিক হিসেবে কোনও ধরনের অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়নি।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা মনে করেননি যে, শিখ নেতা নিজ্জার একজন সন্ত্রাসী ছিলেন, মনে করেননি যে তিনি এই দেশের জন্য হুমকি। এবং এটিই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
ব্রাউন আরও বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা - সেটি বিদেশি রাষ্ট্র বা কানাডার নিজস্ব সরকারের বিরুদ্ধে হোক না কেন - কানাডিয়ান পরিচয়ের প্রধান সত্ত্বা। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি বিশ্ব সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে আপনার মতামত প্রকাশ করতে না পারেন, আপনি যদি ভয় পান যে- বিদেশি সরকারের এজেন্ট আপনাকে হত্যা করবে বা আপনাকে টার্গেট করবে, তাহলে সেই সমাজ আর উন্মুক্ত সমাজ থাকবে না।’
কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যান্য অ্যাডভোকেটরাও ব্রাউনের এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিধ্বনি করছেন। তারা কানাডার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করতে এবং কানাডীয় পররাষ্ট্র নীতিতে মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য অটোয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অবশ্য বছরের পর বছর ধরে মুসলিমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের অধীনে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের নিন্দা করে আসছেন। তাদের অভিযোগ, ভারতে বৈষম্যমূলক আইন হয়েছে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েছে।
নয়াদিল্লি অবশ্য এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানবাধিকার গোষ্ঠী জাস্টিস ফর অল কানাডা। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ত্বহা গাইয়ুর বলেছেন, শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করেছে।
আল জাজিরাকে তিনি বলছেন, ‘উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কানাডায় ভারতীয় মুসলমানরা ভারতে যা ঘটছে তা নিয়ে কথা বলতে বা এমনকি একটি শব্দও বলার বিষয়েও খুব উদ্বিগ্ন। কারণ তারা জানে, এখানে কথা বললে ভারতে তাদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার খুব গুরুতর আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ভারতীয় মুসলমান কথা না বলার জন্য অনেক চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাই এখানে এই ভয়টাও আছে।’
গাইয়ুর বলেন, কানাডায় শিখ এবং মুসলমানরা ঐকবদ্ধ হয়েছে, কারণ তারা উভয়ই দৃশ্যমান ধর্মীয় সংখ্যালঘু। কানাডার মুসলিম এবং শিখ নেতারা এখন তাদের সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে এমন ‘স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় বিদ্বেষের বিষয়ে কথা বলছেন’।
কানাডা সরকার অবশ্য ভারতের বিরুদ্ধে আনা তার অভিযোগের সমর্থনে কোনও প্রমাণ প্রকাশ করেনি। এই বিষয়ে তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছে উত্তর আমেরিকার এই দেশটি। গত সপ্তাহে, ট্রুডো নয়াদিল্লিকে তদন্তে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা ভারত সরকারকে আমাদের সাথে কাজ করার জন্য, এই অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার জন্য এবং ন্যায়বিচারের পথ অনুসরণ করার জন্য আহ্বান জানাই।’
কানাডার মন্ট্রিল-ভিত্তিক মুসলিম সম্প্রদায়ের আইনজীবী শাহীন আশরাফ অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর ওপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রকাশ্যে আনতেন না।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘কিছু কিছু দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র আছে যারা এই ধরনের কাজ করে, কিন্তু ভারত এটা করবে এমন আশা আমি করিনি।’
আশরাফ বলেন, নিজ্জার হত্যায় ভারত সরকারের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে জানার পরে তিনি ‘অবাক’ এবং ‘হতাশ’ হয়েছেন। তিনি বলেন, সহিংসতা কখনোই কোনও সমস্যার সমাধান নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম কানাডিয়ানরা মারাত্মক সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আল জাজিরা বলছে, ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেক সিটির একটি মসজিদে অতি-ডানপন্থি এক বন্দুকধারী ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ২০২১ সালে এক ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্টারিওর লন্ডনে এক মুসলিম পরিবারের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে চারজনকে হত্যা করে।
এসব ঘটনাকে সেসময় কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন।
লন্ডন কাউন্সিল অব ইমামস-এর প্রধান আবদ আলফাতাহ তাওয়াক্কল উল্লেখ করেছেন, দুই বছর আগে ওই হামলার পর স্থানীয় মুসলমানরা শিখদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। সেসময় শিখ সম্প্রদায়ের সদস্যরা মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিল এবং পানি বিতরণ করেছিল।
তাওয়াক্কল বলেন, কানাডা বিশাল এক দেশ যেখানে বিপুল সংখ্যক মুসলিম বাস করেন। কিন্তু লন্ডনের মুসলিমরা এখনও ২০২১ সালের সেই হামলার ক্ষত টানছে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিচার কেবল চলতি মাসে শুরু হয়েছে।
আল জাজিরাকে তিনি বলছেন, ‘এখানে মানুষের মনে ভয় রয়েছে। লোকেদের নিরাপত্তার অভাব বা নিরাপত্তা বোধ নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। যদি বিদেশি সরকার এই ধরনের কর্মকাণ্ডগুলো করতে সক্ষম হয় ... তাহলে সেটি মানুষকে আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।’