বিগত কয়েক শ বছরের মধ্যে গত জুনে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা দেখেছে বিশ্ব। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই শতভাগ দায়ী। এর চেয়েও দুঃখজনক বিষয় হলো—মানবজাতি এই ভয়াবহ দুর্যোগ নিয়ে স্রেফ উটপাখির মতো আচরণ করছে। ঝড়ের মধ্যে যেন বালির ঢিবিতে মাথা গুঁজে বাঁচতে চাচ্ছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
এরই মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চলতি জুলাই বিশ্বের ইতিহাসে কয়েক কয়েক শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ মাস হতে যাচ্ছে। এর আগে, সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু এ বছর সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৬ সালের ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছাড়িয়ে এ বছর রেকর্ড করা হয়েছে গড়ে ১৭ দশমিক ০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যাপক নিঃসরণের কারণে বিশ্ব উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে এবং এর পেছনে মানুষই শতভাগ দায়ী। এ বিষয়ে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. ফ্রেডেরিক অটো বলেন, ‘তাপমাত্রার এমন ঊর্ধ্বগামী প্রবণতার জন্য মানুষই শতভাগ দায়ী। ’
বর্তমান সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে অনেকে জলবায়ু চক্র ‘এল নিনো’কে দায়ী করলেও বিষয়টি মানতে নারাজ ড. অটো। তিনি বলেন, ‘জুনে তাপমাত্রার যে নতুন রেকর্ড হয়েছে তা আমাকে অবাক করেছে। সাধারণত এল নিনো যখন শুরু হয়, তখন শুরুতেই এমন প্রভাব ফেলতে পারে না বরং এর মূল স্তরে আসতে অন্তত ৫ থেকে ৬ মাস লাগে। ’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে আসলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ, আগে তাপমাত্রা বা জলবায়ু বোঝাপড়ার জন্য যে মানচিত্র ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই বদলে গেছে। এ বিষয়ে লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিবেশগত ভূ-বিদ্যার গবেষক থমাস স্মিথ বলেন, ‘সর্বশেষ কবে পৃথিবীর কোন অঞ্চল এমন অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত (তাপমাত্রার কারণে) হয়েছিল তা আমার জানা নেই। বর্তমানের পৃথিবী যেন আমাদের কাছে এক অজানা অঞ্চলে পরিণত হয়ে গেছে!’
চলতি গ্রীষ্মে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চারটি রেকর্ড ভেঙে গেছে। সেগুলো হলো—বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ দিন, সবচেয়ে উষ্ণ জুলাই মাস, সবচেয়ে উষ্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং অ্যান্টার্কটিক সাগরের বরফের রেকর্ড গলন। পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত হয়ে গেছে যে—আগামী ১০ বছর আবহাওয়া কেমন যাবে তা অনুমান করা বিজ্ঞানীদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে থমাস স্মিথ বলেন, ‘১৯৯০–এর দশক থেকে একটি মডেল অনুসরণ করে আমরা আবহাওয়া বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছিলাম। কিন্তু আগামী ১০ বছর কেমন যাবে তা অনুমান করা আমাদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। ’ শিগগিরই তাপমাত্রার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ নিম্নগামী হবে সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না থমাস স্মিথ। তাঁর মতে, শিগগিরই পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
তবে একটি বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ হয়ে পড়েছে এবং একই সঙ্গে সমুদ্রও বায়ুমণ্ডল থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি তাপ শোষণ করে অনেক বেশি উষ্ণ হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সায়েন্সের অধ্যাপক ড্যানিয়েলা শ্মিট বলেন, ‘তাপমাত্রা নিয়ে আমরা এখন এমন কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হচ্ছি যা আগে কখনো ঘটেনি। ’
সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াটা আক্ষরিক অর্থেই বিপজ্জনক। কারণ, সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানই বিশ্বের মোট অক্সিজেনের ৫০ শতাংশ এককভাবে উৎপাদন করে। এ বিষয়ে ড্যানিয়েলা শ্মিটের বক্তব্য হলো, ‘যখন আমরা তাপপ্রবাহের কথা আলোচনা করি তখন মানুষ সাধারণত মনে করে যে, গাছ এবং ঘাস মরে যাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। আমরা সমুদ্রের কথা ভুলেই যাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যদি আটলান্টিকের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তাহলে সামুদ্রিক প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অন্তত ৫০ গুণ বেশি খাবার লাগবে। ’
যাই হোক, পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে যাচ্ছে যে—এখন বিজ্ঞানীদের জন্য সামগ্রিকভাবে বিষয়টি বোঝা এবং ব্যাখ্যা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানী ড. ক্যারোলিন হোমস বলেন, ‘পরিস্থিতি অনেকটা এ রকম যে, আপনি একটি খাড়া পাহাড় চূড়া থেকে পড়ে গেছেন। কিন্তু জানেন না খাদের তলাটা কত গভীরে। ’
তবে এখনো আশা ফুরিয়ে যায়নি। এ বিষয়ে ড. ফ্রেডেরিক অটোর ভাষ্য হলো, ‘এখনো আমাদের হাতে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। আমরা এখনই যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিই তাহলে, আমরা মানবপ্রজাতি এবং পৃথিবীকে কোনোভাবেই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব না। ’