ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গাজায় হামাসের শীর্ষ কমান্ডারদের মাত্র অল্প কয়েকজন ইসরায়েলে বৃহৎ পরিসরে চালানো আকস্মিক হামলার তথ্য জানতেন। এমনকি হামাসের অনেক সদস্য এবং অন্যতম মিত্র ইরানও এই হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতো না। তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘যদি গাজা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের শিকার হয়, তাহলে ইরান ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মতো মিত্ররা সেই যুদ্ধে যোগ দেবে।’
সোমবার মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন লেবাননে নির্বাসিত হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা আলী বারাকেহ। গত শনিবার ভোরের দিকে হামাসের বিধ্বংসী হামলা ইসরায়েলের প্রতাপশালী সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে একেবারে অপ্রস্তুত করে তোলে। বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপের পাশাপাশি স্থল সীমান্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাসের শত শত যোদ্ধা। পাশাপাশি সমুদ্র ও আকাশপথেও ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালায় হামাস।
ইসরায়েলে গাজার ক্ষমতাসীন এই গোষ্ঠীর হামলা চতুর্থ দিনেও অব্যাহত আছে। এতে ইসরায়েলে এখন পর্যন্ত ৯ শতাধিক সৈন্য ও বেসামরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া হামাসের যোদ্ধারা দেড়শ জনের বেশি ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছে।
বারাকেহ বলেছেন, গাজার প্রায় দেড় ডজন শীর্ষস্থানীয় হামাস কমান্ডার এই হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও কখন এই হামলা চালানো হবে সে সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। গত সপ্তাহে বৈরুতে এক বৈঠকে ইরানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা হামলার পরিকল্পনায় সহায়তা বা অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছেন তিনি।
হামাসের এই নেতা বলেন, ‘মাত্র কয়েকজন হামাস কমান্ডার হামলার সঠিক সময় সম্পর্কে জানতেন।’ হামাসের কেন্দ্রীয় কমান্ড বা হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর কোনও সদস্য গত সপ্তাহে লেবাননের রাজধানীতে ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
অতীতে হামাসকে ইরান এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ সহায়তা করেছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি। তবে ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর থেকে হামাস নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রকেট তৈরি এবং যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
সোমবার ইসরায়েলের সরকারের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইরান হামাসকে ইসরায়েলে ব্যাপক অনুপ্রবেশ এবং প্রাণঘাতী হামলা চালানোর জন্য চাপ দিয়েছে বলে ইসরায়েল তথ্য পেয়েছে। এছাড়া হিজবুল্লাহকেও ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হতে চাপ দিয়েছে ইরান।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন, শেষ পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে ইসরায়েল। ইরানকে ‘অক্টোপাস’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, এই অক্টোপাসই হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং হিজবুল্লাহকে পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানি শত্রুর মুখোমুখি হয়েছি— হামাস, ইসলামিক জিহাদ, হিজবুল্লাহ, ইরান। আমরা একটি নাৎসি ধারণার সম্মুখীন হয়েছি। নাফতালি বেনেট বলেন, আমি অতীতে এসব বলিনি। ওরা এসে জবাই করবে, বাচ্চাদের গলা কাটবে এটা আমি কখনও ভাবিনি। ওরা পশু। ওরা শত্রু রাষ্ট্র নয়। তাদেরকে নাৎসি মনে করে আমাদের এটি মোকাবিলা করতে হবে। আমরা নাৎসিদের সাথে যা করব, তাদের সাথে তাই করব।’
মঙ্গলবার ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল-১২ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক সংকট বিশেষজ্ঞ আনাত হোচবার্গ-মারম বলেছেন, হামলায় ইরানের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
ইরানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, হামাসের প্রতি ইরানের দীর্ঘদিনের সমর্থন রয়েছে। তবে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ইরানের সরাসরি অংশগ্রহণ কিংবা রিসোর্সিংয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব কোনও আলামত এখনও পায়নি।
ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকে সৌদি আরবকে রাজি করাতে মার্কিন প্রচেষ্টা ভেস্তে দেওয়াই ইসরায়েলে হামলার লক্ষ্য বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন হামাস নেতা বারাকেহ। তিনি বলেছিলেন, জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট স্থাপনায় ইসরায়েলিদের পরিদর্শন, ইসরায়েলের হাতে বন্দী ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপ বৃদ্ধিসহ গত এক বছরে ইসরায়েলের কট্টরপন্থী সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এই হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, হামাস বিশ্বাস করে ইসরায়েল হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করেছে।
বারাকেহ বলেন, এমনকি হামাসও এই অভিযানের ব্যাপকতা নিয়ে অবাক হয়েছে। ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামের এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিরোধ বা সীমিত করে ফেলা হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন তিনি। হামাসের এই নেতা বলেছেন, আমরা ইসরায়েলের এমন ভয়াবহ পতনে বিস্মিত। আমরা কিছু অর্জন এবং বন্দীদের বিনিময়ের পরিকল্পনা করেছিলাম। আসলে ইসরায়েলের এই বাহিনী ‘কাগুজে বাঘ।’
তার দাবি, হামাস কেবল ছোট্ট এক অভিযানের পরিকল্পনা নেয়, যেখানে মূলত এক হাজারের মতো সদস্য স্থল, সমুদ্র এবং এমনকি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ এবং আক্রমণ চালাবে।
হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং হামাসকে আগের মতো শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেছে। গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযান পরিচালনার জন্য রিজার্ভে থাকা ৩ লাখ সৈন্যকে তলব করেছে ইসরায়েল। এর ফলে গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের পুনর্দখলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা ইতিমধ্যে কয়েকশ হামাস যোদ্ধাকে হত্যা এবং হামাসের অসংখ্য লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে।