এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী:
বর্তমান সময়ে চালু ইসলামে ‘মো’মেন’, ‘মুসলিম’ ও ‘উম্মতে মোহাম্মদী’ এই তিনটিকে একই অর্থবোধক শব্দ হিসাবে মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তিনটিই আলাদা, যদিও পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ধারণা সঠিক করার জন্য এই তফাৎ বুঝে নেওয়া দরকার।
মো’মেন: মোমেন শব্দটি এসেছে ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস থেকে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, “তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে এবং আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ (সুরা হুজরাত ১৫)।” আল্লাহর দেয়া প্রকৃত মো’মেনের এই সংজ্ঞাটা ঠিকভাবে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে “আল্লাহর ওপর ঈমান” এর অর্থ শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে ও একত্বের ওপর ঈমান নয়, তাঁর উলুহিয়াতের ওপর, সার্বভৌমত্বের ওপর (ঝড়াবৎবরমহঃু) ঈমান। এই ঈমান তখনই পূর্ণাঙ্গতা পাবে যখন এই সাক্ষ্য দেওয়া হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন আদেশদাতা, হুকুমদাতা নেই।
আল্লাহর দেয়া মো’মেনের এই সংজ্ঞার দ্বিতীয় ভাগ হলো প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করা। কী জন্য সংগ্রাম করা? আল্লাহর তওহীদের, সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত দীনটি যদি মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা, কার্যকর না হয় তবে ওটা অর্থহীন। কাজেই আল্লাহর তওহীদভিত্তিক ঐ দীনুল হক, সত্য জীবন-ব্যবস্থাটা মানব জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টার আদেশ দিয়েছেন আল্লাহ। এই দু’টি একত্রে প্রকৃত মো’মেনের সংজ্ঞা। এই দু’টি যার বা যাদের মধ্যে আছে, আল্লাহর দেয়া সংজ্ঞা মোতাবেক সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন। এই সংজ্ঞায় আল্লাহ বলেন নাই যে, যে সালাহ পড়বে সে মো’মেন, বা যে রোযা রাখবে সে মো’মেন, বা যে হজ্ব করবে, বা অন্য যে কোন পূণ্য, সওয়াবের কাজ করবে সে মো’মেন। এ সংজ্ঞায় শুধু আছে আল্লাহ ছাড়া আর সমস্ত রকম প্রভূত্ব, সার্বভৌমত্ব অস্বীকার ও আল্লাহর পথে সংগ্রাম। এর ঠিক বিপরীতে তিনি এ সতর্কবাণীও বলেছেন যে, এ তওহীদে যে বা যারা থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোন একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরী আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বা সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে মানবে তারা শেরক করবে। আর শেরক ক্ষমা না করার জন্য আল্লাহ অঙ্গীকারবদ্ধ (কোর’আন- সুরা নিসা ৪৮)।
দ্বিতীয়তঃ মুসলিম শব্দ এসেছে সালাম থেকে। যিনি বা যারা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা, দীনকে সামগ্রিকভাবে তসলিম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ করে তা জাতীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন, অন্যসব রকম ব্যবস্থাকে বর্জন করেছেন তিনি বা তারা মুসলিম। এখানেও একজন মুসলিম হয়েও মো’মেন নাও হতে পারেন। যেমন- কোথাও দেশসুদ্ধ সকলে মুসলিম হয়ে গেল। সেখানে একজন বা কিছুসংখ্যক মোশরেক বা নাস্তিক নানা রকম সামাজিক অসুবিধার কথা চিন্তা করে মুসলিম হয়ে গেল, অর্থাৎ আল্লাহ, রসুল ও ইসলামকে পূর্ণভাবে বিশ্বাস না করেও সমাজের অন্য সবার সাথে আল্লাহর আইন ও দীন স্বীকার ও তসলিম করে নিল। এ লোক মুসলিম, কিন্তু মো’মেন নয়। এর উদাহরণ দেওয়া যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই। নবী করীমের ওফাতের আগেই সম্পূর্ণ আবর মুসলিম হয়ে গিয়েছিল এটা ইতিহাস। কিন্তু আল্লাহ নবীকে সম্বোধন করে বলেছেন-“আরবরা বলে, আমরা বিশ্বাস করেছি (ঈমান এনেছি)। বল, তোমরা বিশ্বাস করনি। বরং বল, আমরা শুধু আত্মসমর্পণ করেছি। কারণ বিশ্বাস (ঈমান) তোমাদের আত্মায় প্রবেশ করে নি।”
আল্লাহর কথা যে সত্য তা প্রমাণ হয়ে গেল রসুলাল্লাহ এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই। চারদিকে বহু লোক ইসলামকে অস্বীকার করে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করার ফলে তারা বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে ইসলামকে স্বীকার করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সত্যিকার বিশ্বাস তারা করেনি, তারা মুসলিম হয়েছিল, কিন্তু মো’মেন হয় নি। আবু বকরের (রাঃ) নেতৃত্বে ঐ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করে সেদিন যারা ইসলামকে রক্ষা করেছিলেন, তারা ছিলেন মো’মেন। কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে, মো’মেন ও মুসলিমদের আল্লাহ আলাদাভাবে সম্বোধন করা ছাড়াও মো’মেন কারা তা তিনি সুরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। আল্লাহর দেয়া মো’মেনের সংজ্ঞায় দু’টি শর্ত দেয়া হলো; একটি ঈমান, অর্থাৎ তওহীদ, অন্যটি ঐ তওহীদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বর্তমানে মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটিতে এ দু’টি শর্তের একটিও নেই। আকিদার বিকৃতিতে আমরা জীবনের সমস্ত অঙ্গন থেকে তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তি জীবনে সংকুচিত করে রেখেছি- যা প্রকৃতপক্ষে র্শেক। আর শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো উৎখাতই করে দিয়েছি এবং তারপরও নিজেদের মো’মেন ও মুসলিম বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করছি।
মো’মেন ও মুসলিম যে এক নয় তা হাদিস থেকেও দেখাচ্ছি। সা’দ (রা.) বলছেন- একবার আমি রসুলাল্লাহর কাছে বসা ছিলাম- যখন তিনি একদল লোককে দান করছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক বসা ছিলেন যাকে আমি একজন উত্তম মো’মেন বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁকে কিছুই দিলেন না। এ দেখে আমি বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনি ওনাকে কিছু দিলেন না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি একজন মো’মেন। রসুলাল্লাহ বললেন, মো’মেন বলো না, মুসলিম বলো। আমি কিছু সময় চুপ থেকে আবার ঐ কথা বললাম এবং তিনিও আবার ঐ জবাবই দিলেন-মো’মেন বলো না, মুসলিম বলো। তৃতীয়বার আমি ঐ কথা বললে রসুলাল্লাহ বললেন সা’দ! আমি অপছন্দনীয় লোকদেরও দান করি এই কারণে যে আমার আশংকা হয় তারা অভাবের চাপে জাহান্নামের পথে চলে যেতে পারে (হাদিস-বোখারি)।” এখানে মহানবীর কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে মো’মেন ও মুসলিম এক নয়। ওইদিন আল্লাহর রসুল দান করছিলেন মুসলিমদেরকে, মো’মেনদেরকে নয়।
তৃতীয়তঃ উম্মতে মোহাম্মদী। আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে তার প্রত্যেক নবী-রসুল (আ.) কে পাঠিয়েছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্য দিয়ে তাহলো যার যার জাতির মধ্যে আল্লাহর তওহীদ ও আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা দীন প্রতিষ্ঠা করা। শেষ নবীকে পাঠালেন সমস্ত মানবজাতির উপর এই দীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য (কোর’আন-সুরা আল-ফাতাহ-২৮, সুরা আত-তওবা-৩৩, সুরা আস-সফ্-৯)। পূর্ববর্তী নবীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিল ছোট। কিন্তু এই শেষ জনের দায়িত্ব হলো এত বিরাট যে এক জীবনে তা পূর্ণ করে যাওয়া অসম্ভব। তাই তিনি এমন একটি জাতি সৃষ্টি করলেন পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পরও যে জাতি তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তারই মত সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হলো তার উম্মাহ-উম্মতে মোহাম্মদী- মোহাম্মদের জাতি। রসুলাল্লাহ যতদিন এই পৃথিবীতে রইলেন ততদিন তিনি নিজে তাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিলেন। মাত্র দশ বছরের মধ্যে আটাত্তরটি যুদ্ধ সংঘটিত করে, একটি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি গঠন করে তিনি তাঁর প্রেরক প্রভুর কাছে চলে গেলেন। যে অপরাজেয় যোদ্ধা জাতিটি তিনি গঠন করে গেলেন সে জাতির আকিদার মধ্যে তিনি সুস্পষ্টভাবে গেঁথে দিয়ে গেলেন যে তাঁর ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব- সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করা, তাঁর অবর্তমানে তাঁর গঠিত এই উম্মাহর ওপর অর্পিত হয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি বিশ্বনবীকে প্রেরিত বলে স্বীকার করে এই দীনে প্রবেশ করলেন; অর্থাৎ আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেই রসুলাল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে আল্লাহর রসুল! এখন আমার কাজ কী? কর্তব্য কী?” আল্লাহর শেষ নবী যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমরা ইতিহাসে ও হাদিসে পাই। তিনি বললেন, “এখন থেকে আমার যে কাজ তোমারও সেই কাজ।” কোনো সন্দেহ নেই যে যদি প্রত্যেকটি মানুষ-যারা ঈমান এনে মহানবীর হাতে মুসলিম হয়েছিলেন তারা আবু বকরে (রা.) মতো- যদি ঐ প্রশ্ন করতেন তবে তিনি প্রত্যেককেই ঐ জবাব দিতেন। “আমার যে কাজ” বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? তাঁর কী কাজ ছিল? তাঁর কাজ তো মাত্র একটা, যে কাজ আল্লাহ তাঁর উপর অর্পণ করেছেন। সেটা হলো সমস্ত রকমের জীবনব্যবস্থা ‘দীন’ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এই শেষ দীনকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে পাচ্ছি, শেষ-ইসলামকে গ্রহণ করার দিনটি থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আবু বকর (রা.) এর কাজ একটাই হয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল মহানবীর সংগ্রামে তাঁর সাথে থেকে তাঁকে সাহায্য করা। শুধু আবু বকর (রা.) নয়, যে বা যারা নবীকে বিশ্বাস করে মুসলিম হয়েছেন সেই মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বা তারা বিশ্বনবীকে তাঁর ঐ সংগ্রামে সাহায্য করে গেছেন, তাঁর সুন্নাহ পালন করে গেছেন। আর কেমন সে সাহায্য! স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করে, বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে, অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে, নির্মম অত্যাচার সহ্য করে, অভিযানে বের হয়ে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়ে। এই হলো তার উম্মাহ, উম্মতে মোহাম্মদী, তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী জাতি। তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে কতখানি সচেতন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বনবীর ইন্তেকালের পর তাঁর উম্মাহর ইতিহাস থেকে। নেতার পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জাতিটি স্বদেশ (আরব) থেকে বের হয়ে উত্তাল ঢেউয়ের মত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল এবং সর্বদিক দিয়ে তাদের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী দুইটি বিশ্বশক্তিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তদানিন্তন অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করল। ঐ উম্মাহর শতকরা আশি জনেরও বেশীর কবর তাদের স্বদেশ আরবের বাইরে হয়েছে। এটাই হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদীর পরিচয়।
বর্তমানে উম্মতে মোহাম্মদী হিসাবে যারা পরিচয় দেন, তাদের কাছে ইসলামের মূল কাজ হলো টাখনুর উপর পায়জামা, খাওয়ার পূর্বে লবন খাওয়া, ডান কাত হয়ে শোওয়া, লম্বা জোব্বা, পাগড়ি, লম্বা দাড়ি, কাঁধে চেক রুমাল আর পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে মিলাদ ও জেকের করা, ব্যাস এই হলো উম্মতে মোহাম্মদী। এদের সামনে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অপরিচিত। দুনিয়াময় পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের শাসন, তাগুতের সার্বভৌমত্ব চলছে নাকি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চলছে, এটা তাদের বিবেচ্য নয়, দুনিয়াময় মুসলিম নামক জাতিটি অন্য জাতির লাথি খাচ্ছে খাক, নির্যাতিত হোক, এদের নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে হোক এটাও তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, এই জাতীয় নির্জীব, নির্বিকার অন্তর্মুখী বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যাকে মানবজাতির সেরা বিপ্লবী রসুলাল্লাহ কি তাঁর উম্মাহ বলে স্বীকার করবেন?
[মূল: মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী, সম্পাদনা: মো: রিয়াদুল হাসান, যোগাযোগ: হেযবুত তওহীদ, ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৭১১-০০৫০২৫]